ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক কেমন হবে?

আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর সর্বত্র আলোচনা চলছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে। তবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক মহলের অনেকেই বিগত দিনের আলোকে বলছেন নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রতিরক্ষা খাতে নতুন ধারা সূচিত হয়েছিল। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার হওয়ায়, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।

বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্বালানি খাতে আমেরিকান বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে দেখা গিয়েছিল। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতি ও চীনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলেছে।

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা চলতে পারে। তবে চীন ও ভারত এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া জানাবে, সেটাও বিবেচ্য বিষয়।

মানবাধিকার বিষয়ক চাপ থাকলেও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের সার্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এটি কোনো বড় প্রভাব ফেলবে না বলে অনেকে মনে করেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব পড়লেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান দুই দলের সঙ্গেই ড. ইউনূসের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া টুইটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে শফিকুল আলম বলেন, তাকে সম্ভবত ভুল বোঝানো হয়েছে। এতদিন তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন। এখন প্রেসিডেন্ট হবেন। এখন নিশ্চয়ই প্রকৃত চিত্র জানতে পারবেন।

বিএনপি নেতা, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ক্ষমতা বদল হলেও মার্কিন নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে না। মার্কিন বাজারে প্রবেশাধিকার ও শুল্ক সংক্রান্ত নীতিগুলো একই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বহুমুখী এবং আমরা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল নই।

তিনি আরও বলেন, আমরা এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর দিকে জোর দেব। বাংলাদেশে আমেরিকান বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গার্মেন্টস, প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে। তাই ব্যবসার প্রসার এবং বিনিয়োগের জন্য বর্তমান নীতি বজায় থাকলে সেটা বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক হবে।

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক নূরুল আমীন বেপারী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফরেন পলিসি আগে থেকেই নির্ধারণ করে থাকে। মেজর ফিল্ডগুলোতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। তবে মাইনর ফিল্ডগুলোতে কিছু পরিবর্তন করতে পারেন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে অতটা মাথা ঘামাবেন না বলে মনে করি। 

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক সাহাব এনাম খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর স্থায়িত্ব। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে, তবে কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ বাড়তে পারে, যা কৌশলগত ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা রয়েছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে তিনি (ট্রাম্প) বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন।

বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোতে জোর দেয় ডেমোক্র্যাট প্রশাসন। কমলা হ্যারিস বা ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সহযোগিতার জায়গাগুলো বাংলাদেশের জন্য সহজ থাকার সুযোগটা বেশি বলেই মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং লেখক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, কমলা হ্যারিস জয়ী হলে বর্তমান সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য বজায় থাকবে, কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দুদেশের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ট্রাম্পের মূল কাজ থাকবে- ইউক্রেনের যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের ব্যাপার, চীনকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, ব্রিকসে কী সমস্যা তা তাঁর দিকে নিয়ে আসা। সেখানে একটি সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে, কয়েকমাস ধরে আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে; সেই মনোযোগটা হয়ত কমে আসতে পারে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিমা ফেরদৌসী বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আহামরি ভালো নাও হতে পারে, সেটার কোনো পথ এখনও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় সে দেশে যেতে বাংলাদেশিরা কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারেন। কারণ নির্বাচনের আগে ট্রাম্প এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ফলে তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে হাঁটেন, তাহলে প্রথমেই আমরা অভিবাসন নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শুধু একটি দলের ওপর নির্ভর করে না। এখানে বাণিজ্যিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিকসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে।

তিনি বলেন, শুধু প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেলেই এক দিনে এটা বদল হয়ে যায় না। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে-ই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না, খুব বেশি দুশ্চিন্তা নেই।

MB/FI
আরও পড়ুন