প্রতিবছরের মতো এবারেও ঈদযাত্রায় অনিশ্চয়তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। এরই মধ্যে রেলপথ , জলপথ এবং স্থলপথের টিকিট উধাও হয়ে গেছে। টার্মিনাল, স্টেশন বা কাউন্টারে গেলে বলা হচ্ছে টিকিট শেষ। তবে অতিরিক্ত টাকা দিলে মিলছে টিকিট এমন অভিযোগ রয়েছে। দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়াও আন্তঃজেলা পরিবহনের শ্রমিকরাও যাত্রী হয়রানিতে শান দিচ্ছে। ঈদের পাঁচ দিন আগের থেকেই তাদের ক্যারিশমা শুরু হবে এমনটিই জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা।
ঢাকা মহানগরীর মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জনের মধ্যে আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আনুমানিক ১ কোটি ৭২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বৃহত্তর ঢাকা ছাড়বে। তারা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার স্থায়ী-অস্থায়ী বাসিন্দা। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ৬০ শতাংশ যাবে সড়ক পথে। বাকি ৪০ শতাংশ নৌ ও রেলপথে যাবে। এই হিসেবে, এবার সড়ক পথে ঈদযাত্রী সংখ্যা মোট এক কোটি তিন লাখ ৬২ হাজার।
আসন্ন-ঈদে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানী ঢাকা থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ গ্রামমুখী হবে। সড়ক, রেল, লঞ্চ এবং আকাশ পথে এসব মানুষ ঢাকা ত্যাগ করবে। সোমবার (২৪ মার্চ) থেকে বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে এ যাত্রা শুরু হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘরে ফেরা বিপুল সংখ্যক মানুষের নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। যা আছে তা সবই কাগজে কলমে। তাই বিগত বছরগুলোর মতো এবারো সেই গতানুগতিক পথেই হাঁটছে সরকার।
এদিকে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো নাকে কাঠি দিয়ে হাঁটছেন না। যদিও তারা বলেছেন, কোনোভাবেই বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে যাত্রী বহন করতে দেওয়া হবে না। কেউ নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবার হুশিয়ারির কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু শেষ কথা বজ্র আঁটুনি ফোসকা গিরো।
সরকারের এই ধরনের অবস্থান অতীতেও ছিল। কিন্তু কোনো বছরই এই অবস্থানের মান্যতা দেওয়া হয়নি। পরিবহন শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে , যাত্রী হয়রানি করেছে তারপরেও প্রশাসন দায়ী পরিবহন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে পরিবহন শ্রমিক মালিকরা মনে করেছেন এসবই লোক দেখানো পদক্ষেপ মাত্র।
সোমবার সকাল থেকে গাবতলী, কমলাপুর রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনাল সরজমিনে ও বেসরকারি সংগঠন সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের তথ্যে এসব বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। সিটিজেন রাইটস বলছে, সরকারের ঢিলেঢালা প্রস্তুতির কারণে ঈদের ৭ দিন বাকী থাকতেই বাস-লঞ্চের অগ্রিম টিকিট উধাও হয়ে গেছে।
বাস মালিক কর্তৃপক্ষ বলেছেন, গত বন্যায় রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সব কোম্পানিই নির্ধারিত ট্রিপের চেয়ে কম ট্রিপের টিকিট ছেড়েছে। ঈদের আগে রাস্তাঘাটের অবস্থা যদি ভালো হয় তাহলে নতুন করে ট্রিপের সংখ্যা বাড়ানো হবে। যদিও এটি গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো অবস্থা!
অন্যদিকে ঈদের আগে ২৯, ৩০ ও ৩১ মার্চের টিকিট পাচ্ছেন না যাত্রীরা। নগরীর বিভিন্ন কাউন্টার থেকে যাত্রীদের বলা হচ্ছে, এসব তারিখের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। লঞ্চের কেবিনের টিকেট নিয়েও চলছে সিন্ডিকেট কারবার। গাবতলী, কল্যাণপুরের একাধিক পরিবহনকর্মী বলেছেন, রাস্তার অবস্থা খারাপ। তাই শেষ সময়ের অগ্রিম টিকিট দেওয়া হবে না। যাত্রার দিনই টিকিট বিক্রি করা হবে।
সদরঘাট:
রাজধানীর একমাত্র নৌবন্দর সদরঘাট। সেখান থেকে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌযান ছেড়ে যায়। সেখানকার লঞ্চ কর্মীরা দাবি করেছেন, অধিকাংশ লঞ্চের কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। অথচ কেবিনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করার কথা ছিল ১৫ রমজান থেকে। কিন্তু বাস্তবে টিকিট বিক্রি আগেই শেষ হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে ঝালকাঠিগামী এমভি টিপু লঞ্চের ভাড়া সিঙ্গেল কেবিন ৬’শ আর ডাবলের জন্য ১১’শ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লঞ্চের এক মালিক জানান, সরকারি হিসাব অনুযায়ী চার্টে ডেকের ভাড়া দেওয়া আছে ২০৪ টাকা। এর চারগুণ বেশি ভাড়া নিতে বলা হয়েছে কেবিন থেকে। ঢাকা-বরিশালগামী পারাবত-৭ লঞ্চের বুকিং ক্লার্ক নজরুল ইসলাম জানান,আসলে গত ১৫ মার্চ থেকে টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। যাত্রী বেশি হওয়ায় ঈদের টিকেট শেষ হয়ে গেছে। এ সময় রহিম নামে এক যাত্রী অভিযোগ করেন, গত বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ঘুরছি, কোনো টিকিট পাইনি।
কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল:
সোমবার সকালে কল্যাণপুরে দূরপাল্লার টিকিট কাউন্টারগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, টিকিটের সন্ধানে ঘুরছেন শত শত ঘরমুখো মানুষ। কাউন্টার থেকে তাদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, টিকিট নেই। মালিকপক্ষ টিকিট আছে দাবি করলেও কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে, শেষ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বাসে বাড়িফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে হাজারো যাত্রীর। আগমনি এক্সপ্রেসের কাউন্টারে গিয়ে রংপুরের টিকিট খুঁজছেন ইমরান হোসেন। তার দরকার ২৭ মার্চের টিকিট। কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, টিকিট নেই। ইমরান হোসেন জানান, ১৫ মার্চ ব্যস্ততার কারণে টিকিট নিতে আসতে পারেননি। এখন পড়েছেন ঝামেলায়। চেষ্টা করছেন টিকিট পাওয়ার। তার বক্তব্য, একশ টাকা বেশি দিতে রাজি, টিকিট পেলেই হয়। তিনি জানান, আগমনি, এসআর ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন কাউন্টারে ঘুরেছেন, কিন্তু কোন টিকিট মেলেনি। তবে টাকা বেশি দিয়ে টিকিট পাওয়া গেছে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে।
এদিকে কলেজ গেটের সামনে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেল। এখান থেকে জানানো হয় উত্তরাঞ্চলের সব রুটের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে রাজশাহী যাওয়ার টিকিট কেটেছেন ফরহাদ হোসেন। তিনি জানান,আগে নেওয়া হতো ৩০০ টাকা, এখন নেওয়া হচ্ছে ৪০০ টাকা। তিনি কাউন্টার থেকে টিকিট নিয়েছেন দাবি করলেও কাউন্টারে খোঁজ নিলে জানানো হয়, টিকিট শেষ। বেশি টাকা দিলে পাওয়া যাবে কি-না জানতে চাইলে বলা হয়, কোনো সিট নাই। ডাবল টাকা দিলেও লাভ নাই।
গাবতলী টার্মিনালের একজন পরিবহন কর্মকর্তা জানান, অগ্রিম টিকেটের ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, অগ্রিম টিকিট দিয়ে ঈদের আগে যানজটের কারণে সিডিউল রক্ষা করতে না পারলে কাউন্টারের কর্মচারীদের তোপের মুখে পড়তে হয়। আবার অনেক যাত্রী সড়কে জ্যাম থাকার কারণে তার নির্ধারিত সময়ে হাজির হকেত ব্যর্থ হন। এসময় উপস্থিত যাত্রীরা অনেক সময় পরিবহন কর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
যা বলছেন কর্তৃপক্ষ:
শিডিউল টিকিট সংকটের ব্যাপারে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কামাল হোসেন নামে এক কর্মকর্তা জানান, এবার টিকিট সংকটের আশঙ্কা আগেই করা হয়েছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে সব কোম্পানিই নির্ধারিত ট্রিপের চেয়ে কম ট্রিপের টিকিট ছেড়েছে। ঈদের আগে রাস্তাঘাটের অবস্থা স্বাভাবিক হলে ট্রিপের সংখ্যা বাড়ানোও হতে পারে। তবে এর সম্ভাবনা খুবই কম।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাপ) সংস্থা বা লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি শাহাব উদ্দিন মিলন জানান, চাহিদার তুলনায় লঞ্চের সংখ্যা অনেক কম। নির্ধারিত সময়ের আগেই লঞ্চের কেবিন শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, যারা লঞ্চের কেবিনের জন্য আবেদন করেছিলেন তাদের দেওয়া হয়েছে।
নৌ উপদেষ্টা পদক্ষেপ:
নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন জানান, যে কোনো দুর্ঘটনা রোধে এ বছর সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করা হবে। তিনি জানান, কোনো ভাবেই লঞ্চে ছাদে যাত্রী বহন করতে দেওয়া হবে না। কেউ নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপদেষ্টা সাধারণ যাত্রীদের অতিরিক্ত যাত্রী না হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
রেলপথ উপদেষ্টা:
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান বলেন, আমাদের বিধি মালায় বলা আছে ট্রেনের ছাদে যাত্রী উঠা সম্পূর্ণ নিষেধ। এ ব্যাপারে রেলওয়ের কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া আছে, যাতে কোন যাত্রী ছাদে না উঠে। ট্রেনের ছাদে যাত্রী না উঠে সে জন্য আমরা শতকরা ২০ ভাগ স্ট্যান্ডিং টিকিটের ব্যবস্থা করেছি।
উপদেষ্টা বলেন, মুসলমানদের বড় দুটি উৎসব হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযাহা। এ উৎসব দুটোর সময় রেলের অনেক যাত্রী হয়। রেলের যাতায়াত অতি আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই রেলের ওপর নির্ভর করেন। আমাদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী শতভাগ সেবা দেয়ার জন্য রেল প্রস্তুত।
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা:
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, জেলা সদরের রাস্তা সংস্কারে জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আশা করি এবারের ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি হবে না। এদিকে এবারে ঈদে আকাশ পথেও যাত্রী বাড়ছে এমনটি জানিয়ে খন্দকার আল ফেরদৌস নামের এক বিমান কর্মকর্তা জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হলে বিমানের সিডিউল ঠিক থাকে না। এছাড়া যে হারে সকাল ও সন্ধ্যায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হচ্ছে তাতে বিমানের সিডিউলে বিপর্যয় নামতে পারে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে বিমানের সিডিউল ব্যর্থ হবার কেন সুযোগ নেই।
