দক্ষিণ মেরুর হিমায়িত মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। সুবিশাল ভূখণ্ডটি ঢাকা রয়েছে বরফের পুরু চাদরে। কোথাও জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। প্রাণী বলতে পেঙ্গুইন, সিল, তিমি আর কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ। প্রবল ঠান্ডার কারণে সেখানকার জীবজগতে অদৃশ্য মেরুদণ্ডী প্রাণী। এমন দুর্গম অ্যান্টার্কটিকায় ‘পিরামিড’-এর হদিস মেলায় রীতিমতো হতভম্ব বিজ্ঞানীরা।
বরফে ঢাকা মহাদেশের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রিভুজাকার ‘পিরামিড’! এমন কিছু ছবি প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে তুমুল হইচই। বিশ্বের দুর্গমতম মহাদেশটিতে কে বা কারা তৈরি করল ওই কাঠামো? নেপথ্যে ভিনগ্রহের কারো হাত? নাকি একটা সময়ে সেখানেও ছিল প্রাচীন সভ্যতা? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ভূবিজ্ঞানী থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
বরফে ঢাকা দক্ষিণ মেরুতে ‘পিরামিড’-এর অস্তিত্ব কোনো অভিযাত্রীদল আবিষ্কার করেছে, তা ভাবলে ভুল হবে। ২০১৬ সালে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে এর হদিস জানতে পারেন গবেষকেরা। অ্যান্টার্কটিকার মধ্যে রয়েছে এলসওয়ার্থ পর্বতমালা। মহাশূন্য থেকে তোলা ছবিতে ‘পিরামিডের চূডড়া’ দেখা গেছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে।
অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ পর্বতমালা হল এই এলসওয়ার্থ। এটি লম্বায় প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৪৮ কিলোমিটার। বরফে ঢাকা মহাদেশটির ম্যারি বাইর্ড ল্যান্ড সংলগ্ন রোন আইস শেলফ থেকে এর উৎপত্তি। ১৯৩৫ সালে পর্বতমালাটি আবিষ্কার করেন লিঙ্কন এল্সওয়ার্থ। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে পরিচিত পায় এই পাহাড়।
ভূবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় সারা বছর গড় তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রি নিচে। খুব অল্প সময়ের জন্য সেখানে পা রাখতে পারেন দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা। সাধারণত, সেটা নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, বছরের এই তিন মাসের মধ্যে হয়ে থাকে।

ফলে এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় ‘পিরামিড’-এর হদিস মিলতেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’। কেউ কেউ বলতে শুরু করেন, মিশর থেকে সেগুলোকে অ্যান্টার্কটিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকে আরও একধাপ এগিয়ে সেগুলোকে জার্মানির বাভারিয়ায় আডাম ভাইসহাউপ্ট প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সংগঠন ‘ইলুমিনাতি’র তৈরি আস্তানা বলে প্রচার চালাতে থাকেন।
‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’-এর একাংশের আবার ধারণা, প্রাগৈতিহাসিক যুগে ব্রাজিলের আমাজনের মতো দুর্ভেদ্য বৃষ্টি অরণ্যে ঢাকা ছিল অ্যান্টার্কটিকা। সেই সময়ে সেখানে পিরামিড আকারের ওই কাঠামোগুলো তৈরি করা হয়। এগুলোর সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাদের দাবি, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় হিমবাহের মিলনের জেরে তৈরি হয়েছে ওই ত্রিভুজাকার পিরামিড সদৃশ চূড়া। এর সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনো সম্পর্ক নেই। গোটা বিষয়টিকে তারা ‘প্রকৃতির খেলা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কিন ভূবিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক এরিক রিগনোট। অ্যান্টার্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ড নিয়ে লম্বা সময় ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন তিনি। তার কথায়, ‘দক্ষিণ মেরুর ওই পিরামিড আকারের চূড়া নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এটা কোনো অতি প্রাকৃতিক ঘটনা বা মানুষের হাতে তৈরি কাঠামো নয়। সেখানকার প্রকৃতিই ওটাকে গড়ে তুলেছে’।
ভূবিজ্ঞানীরা বর্তমানে এল্সওয়ার্থ পর্বতমালার পিরামিডের মতো দেখতে চূড়াগুলিকে ‘হর্ন’ বা খড়্গ বলে অভিহিত করে থাকেন। তারা জানিয়েছেন, অ্যান্টার্কটিকার ওই এলাকায় রয়েছে একাধিক হিমবাহ। অনেক সময়েই পাহাড়ের গা বেয়ে সেগুলো ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামার চেষ্টা করে। এতে হিমবাহের উপরের মোটা তুষারের চাপে পাহাড়ের চূড়া পিরামিডের মাথার মতো উঁচু খাড়াই এবং ছুঁচলো হয়।
এছাড়া আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, বরফে ঢাকা মহাদেশটিতে অনেক সময়ে দুই বা তার বেশি হিমবাহের মিলন দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়কার ঘর্ষণেও পাহাড়ের আকার পিরামিডের মতো হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একাধিক হিমবাহের তীব্র বৃত্তাকার ক্ষয়ের কারণে এগুলো তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, বরফে ঢাকা মহাদেশটিতে অনেক সময়ে দুই বা তার বেশি হিমবাহের মিলন দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়কার ঘর্ষণেও পাহাড়ের আকার পিরামিডের মতো হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একাধিক হিমবাহের তীব্র বৃত্তাকার ক্ষয়ের কারণে এগুলি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পরিবেশবিজ্ঞানী মাউরি পেল্টো জানিয়েছেন, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালা এবং এর কাছের প্যাট্রিয়ট পাহাড় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে। অ্যান্টার্কটিকার মতো প্রবল ঠান্ডার জায়গায় এই ধরনের চূড়া তৈরি হওয়া একেবারেই আশ্চর্যের নয়। মেরু বিজ্ঞানীরা বিষয়টি তাদের রচনায় নথিবদ্ধও করেছেন।
