ঢাকা
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

আতঙ্কে আমানতকারীরা

একীভূতের খবরে পদ্মা ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক

আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম

আর্থিক খাতে দুর্বলতার জন্য দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে প্রচলিত নিয়মে পরিচালিত দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক। গত সোমবার (১৮ মার্চ) বেসরকারি খাতের এ দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে মার্জারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে দুই ব্যাংক একীভূত হওয়ার খবরে আতঙ্ক বিরাজ করছে আমানতকারীদের মধ্যে। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংকের শাখায় টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার দিন ও পরের দিন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় ভিড় করছেন আমানতকারীরা। তবে স্বল্প আমানতকারীদের টাকা তোলার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। শাখাপ্রধানরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি চাপ পড়ছে।

একীভূত কার্যক্রম শুরুর পর গতকাল মঙ্গলবার  ছিল প্রথম কার্যদিবস। রাজধানীর মতিঝিল শাখায় সকাল থেকেই স্বাভাবিক দিনের চেয়ে গ্রাহকদের বেশ আনাগোনা দেখা গেছে। এরমধ্যে আমানতকারীদের ভিড় কিছুটা বেশি ছিল। স্বল্প অঙ্কের টাকা সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হলেও বড় অঙ্কের জন্য সময় নিচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। টাকা উত্তোলন করতে আসা মাহির দম্পতি বলেন,আমাদের অল্প টাকা তাই তুলতে এসেছি। সাথে সাথে দিয়ে দিয়েছে। এসময় আরেক গ্রাহক বলেন, পাঁচ লাখ টাকা তোলার জন্য এসেছি, আমাকে দুই দিন পরে আসতে বলেছে।

তবে শুধু টাকা তুলতেই নয় ,অনেকেই আসছেন ব্যাংকের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য। কাঞ্চন নামের এক গ্রাহক বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন করি পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে। মার্জারের খবর শোনার পর খোঁজ নিতে এসেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন কোনো সমস্যা হবে না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক আমানতকারী বলেন, আমার আমানত ম্যাচিউর হয়েছে। কিন্তু আজকে তারা টাকা দেয় নি, সপ্তাহখানেক পর আসতে বলেছে।

আরেক গ্রাহক বলেন,ব্যাংকে টাকা রাখলে আতঙ্ক তো কিছুটা থাকবেই। এখন যেহেতু এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে, তাই সমস্যা নাও হতে পারে। এখন দেখা যাক কী হয়।

এদিকে হঠাৎ করেই টাকা উত্তোলনকারী আমানতকারীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে কর্মকর্তাদের ওপর। তারা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করছে।

এ বিষয়ে মতিঝিল শাখাপ্রধান মনির হোসাইন বলেন, স্বাভাবিকের তুলনায় টাকা তোলার চাপ অনেক বেড়েছে। অনেকের ডিপোজিট ম্যাচিউরিটি আসার আগেই টাকা তুলতে চাচ্ছেন। স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ পার্সেন্ট ট্রেডিশনাল একটা প্রেসার পড়েছে। কারণ মানুষের মধ্যে একটা বিষয় কাজ করছে টাকা দেবে কি না, এটা স্বাভাবিক। আমরা গ্রাহকদের বোঝাচ্ছি। অনেকে বুঝতেছে অনেকে বুঝতেছে না। আমরা টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

শুধু মতিঝিলই নয়, রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি শাখায় খোঁজ নিয়ে একই অবস্থার কথা জানা গেছে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকে ১ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে গত দুই বছরেই গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো। এ ছাড়া অনেক সংকটের মধ্যে গত তিন বছরে ৩৫০ কোটি টাকা আমানত পেয়েছি। তাতে বর্তমানে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। খেলাপির ঋণ ৬৭ শতাংশ থেকে ৬১ দশমিক ৮৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। এ ছাড়া পাঁচটি ইসলামি উইন্ডো চালু করেছি। গত দুই বছরে দুটি পূর্ণাঙ্গ শাখা এবং ১৪টি উপশাখা বেড়েছে পদ্মা ব্যাংকের। গত পাঁচ বছরে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদের সহযোগিতা ও কর্মীদের দক্ষতার কারণে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ৮৭৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক এখন একেবারেই প্রান্তিক মানুষকে সেবা দেবে। প্রান্তিক মানুষকে সেবা দিয়ে তাদেরও স্মার্ট উদ্যোক্তা তৈরি করবে পদ্মা ব্যাংক। প্রান্তিক মানুষকে সব ধরনের সেবা দিবে পদ্মা ব্যাংক। বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের ৬০টি শাখা ও ৬টি উপশাখা রয়েছে। গত দুই বছরে গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো।’

দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে প্রচলিত নিয়মে পরিচালিত পদ্মা ব্যাংক।এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের এ দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই হয়েছে। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এ চুক্তি হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আফজাল করিম।

দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করে। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

এরপর ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এ রকম অবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পদ্মা। এর ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছর অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বর্তমানে এটি ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ইতিমধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত করতে পরিচালক পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করল এক্সিম ব্যাংক। 

AHA/AST
আরও পড়ুন