এবার ঈদুল আজহার লম্বা ছুটি পাচ্ছেন দেশবাসী। ঈদের ছুটি মানেই নানা আয়োজন। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে জম্পেশ আড্ডা, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো আর মজাদার খাবারের স্বাদ গ্রহণ। অনেকে কোথায় যাবেন তা নিয়ে দ্বিধায় বাড়ির কাছের দর্শনীয় স্থান পর্যন্ত দেখতে পারেন না। সমস্যা নেই, যশোরসহ আশপাশের এলাকার ঈদে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের জন্য কিছু দর্শনীয় স্থান তুলে ধরা হলো।
যশোর জেলার এসব দর্শনীয় স্থানের কয়েকটির যেমন রয়েছে ঐহিতাসিক গুরুত্ব, তেমনি এর সাথে মিশে আছে মানুষের আবেগ, অনুভূতি আর ভালোবাসার সংমিশ্রণ। কোনোটি নিছক বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয়। অনেকগুলোর রয়েছে ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব। ঈদের ছুটিতে যশোরের এসব দর্শনীয় স্থানে উৎসবে রঙিন হতে পারেন যে কেউ।
যশোর শহরেই হতে পারে জম্পেশ আড্ডা
বৃটিশ-ভারতের প্রথম জেলা যশোর শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরসীম। প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা। যশোর টাউন হল ময়দানের মুক্তমঞ্চে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই জনসভা। ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান, সাথে দেশে বেসরকারি পর্যায়ের বৃহৎ পাঠাগার যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি দেখে আসতে পারেন যে কেউ। সাথে রয়েছে বি. সরকার ঘূর্ণায়মান মঞ্চও। শহরের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান যশোর কালেক্টরেট ভবন।

যশোর শহরের আশপাশে যত দর্শনীয় স্থান
যশোর শহরের আশপাশের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের একটি চাঁচড়া শিব মন্দির। তিনশ’ ২৯ বছর পুরনো এই মন্দিরটি পুরার্কীতি হিসেবে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত। এর বিশেষ বৈশিষ্ট হলো নির্মাণে আট-চালা রীতি অনুসরণ। পুরো মন্দিরের সামনের অংশ পোড়ামাটি দিয়ে অংলকৃত করা। এটি ছিল চাঁচড়ার জমিদারবাড়ির অংশবিশেষ। কালের বিবর্তনে এবং মানুষের কবলে পড়ে এই মন্দিরটি ছাড়া রাজবাড়ির আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই।
অবসরে দেখে আসা যায় যশোর শহরের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থান মুড়লি জোড়া শিব মন্দির। রাজা লক্ষ্মণ সেন ১১৮৯ সালে ভৈরব নদের পশ্চিমাংশে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। এটিও এখন ধর্মীয় স্থানের পাশাপাশি দর্শনীয় এক পুরাকীর্তি হিসেবে কালের স্বাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
মুড়লির আর একটি দর্শনীয় স্থান ইমামবাড়া। যা মুড়লি ইমামবাড়া নামেও পরিচিত। ১৮০২ সালে দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসিনের বোন মন্নুজান এটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি বাংলাদেশের পুরাকীর্তির অংশ হিসেবে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
শংকরপুরে অবস্থিত যশোর মেডিকেল কলেজ এলাকাটিও দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পাশে মুক্ত বাতাসে চা-কফির স্বাদ নিতে নিতে প্রাণখোলা আড্ডায় মেতে ওঠার মজাই আলাদা।
যশোরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে বিমানবন্দর অন্যতম। শহরের নিকটবর্তী হওয়ায় বিমানবন্দর ও বাইপাস বিকেল থেকেই মানুষের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে। সময়মতো যেতে পারলে শিশুদের বিমান ওঠা-নামার দৃশ্যও দেখানো যায়। রানওয়ের মাথায় রয়েছে যশোর বিমানবন্দর পার্ক এবং জাদুঘর।
বোটক্লাব
যশোর শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে বিমানবন্দরের পেছনে অবস্থিত যশোর বোটক্লাব। চারদিকে পানির বিশাল সম্ভারে ছোট ছোট বোটে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। শিশুদের জন্য রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা।

বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক
বোটক্লাবে যাওয়ার আগেই যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের ক্যান্টনমেন্টের শানতলায় অবস্থিত সেনাবাহিনী পরিচালিত বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক। এখানে রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা, নদী, রবীনহুডের ঘর, ভুতেরবাড়ি, কৃত্রিম ঝরণা, পদ্মপুকুর, জলপরি এবং বিভিন্ন রাইড। পার্কটির শান্ত পরিবেশ আড্ডার জন্যে বেশ উপযোগী।

জেস গার্ডেন
যশোর উপশহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে যশোর-মাগুরা সড়কের বাহাদুরপুর গ্রামে অবস্থিত জেস গার্ডেন বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত। এখানে আছে মিনি চিড়িয়াখানা, রোপওয়ে, বোট, দোলনা ইত্যাদি। যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু রাইড। গ্রামীণ এই পরিবেশটি বেশ শান্ত।
যেতে পারেন জেলা শহরের বাইরেও
ফুলের রাজ্য গদখালী
ফুলের রাজ্য গদখালীর নাম দেশবাসীর মুখে মুখে। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার এই স্থানটি বছরের যে কোনো সময়ই ভ্রমণের জন্য আদর্শ। এটি এখন পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যাপক সমাদৃত। এখানকার হাড়িয়া, পানিসারা, গদখালীর মোহনার ফুল মোড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক পার্ক। যার প্রতিটিতে দেশি-বিদেশি নানা ফুলের বাগান, ফুল দিয়ে সাজানো পথের ধার, মাথার ওপরে রং-বেরঙের ছাতা, ফটোস্ট্যান্ড আর নানা ধরনের রাইডে ভেসে বেড়াতে একটুও ক্লান্তি ভর করবে না।
ভাসমান সেতু
পিলার বা খুঁটি ছাড়া সহস্রাধিক প্লাস্টিকেট ড্রামের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের যাতায়াতের জন্য সেতু। অভিনব এই নির্মাণ শৈলি দিয়ে দেশের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেছেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ এলাকার একদল স্বপ্নবাজ যুবক। স্থানীয় ঝাঁপা বাওড়ের ওপর তাদের নির্মিত দুটি সেতু দেশব্যাপী আলোচিত এবং দর্শনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিদিন বিপুল মানুষ ঝাঁপার ভাসমান সেতু দেখতে রাজগঞ্জে পাড়ি জমান। ঈদের ছুটিতে ঝাঁপা সেতুও ওপর দিয়ে হাঁটার মজা নেওয়ার অনুভূতি হতে পারে জীবনের এক অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত।
ভরতের দেউল
যশোরের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় এক স্থান কেশবপুর উপজেলার ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল। এটি উপজেলার ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন গুপ্ত যুগের খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। টিলা আকৃতির দেউলের উচ্চতা ১২.২০ মিটার এবং পরিধি ২৬৬ মিটার। কয়েকদফা খনন চালায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বেরিয়ে আসে দেউলের আকার, মঞ্চ, মন্দির এবং প্রায় ৯৪টি কক্ষ। চারপাশে চারটি উইং ওয়ালে ঘেরা ১২টি কক্ষ ছাড়া বাকি ৮২টি কক্ষগুলো বৌদ্ধ স্তুপাকারে তৈরি। আর স্তুপের চূড়ায় থাকা চারটি কক্ষের দুইপাশে আরও আটটি ছোট ছোট কক্ষ দেখা যায়। এখানে প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে পোড়া মাটির তৈরি নারীর মুখমন্ডল, নকশা করা ইট, পোড়ামাটির অলংকার, মাটির ডাবর এবং দেবদেবীর টেরাকোটার ভগ্নাংশ। ভরতের দেউল দেখতে ঈদের ছুটিতে প্রচুর দর্শণার্থীর উপস্থিতি ঘটে। এখানে ভ্রমণে বাড়তি পাওনা হতে পারে চুকনগরের বিখ্যাত আব্বাসের হোটেলের চুই ঝালের খাসির মাংসের স্বাদ গ্রহণ।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি হতে পারে ঈদের ঘোরাঘুরির জন্য উত্তম স্থান। বাংলা কবিতায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি কপোতাক্ষ নদ বিধৌত এই সাগরদাঁড়িতে। এখানকার প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাইকেলের নানান স্মৃতি।
মীর্জানগর হাম্মামখানা
যশোরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে মীর্জানগর জমিদার বাড়ি উল্লেখযোগ্য। কেশবপুর উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে কপোতাক্ষ ও বুড়িভদ্রা নদীর ত্রিমোহিনীতে মীর্জানগর গ্রামে এর অবস্থান। জমিদারবাড়ির হাম্মামখানা বা গোসলখানা তখনকার সময়কার স্থাপত্য শৈলির বিস্ময়। দশ ফুট উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত দূর্গের এক অংশে হাম্মামখানা স্থাপন করা হয়। মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে তৈরি হাম্মামখানায় চারটি কক্ষ ও একটি কূপ রয়েছে। চার গম্বুজ বিশিষ্ট হাম্মামখানার পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দুটি করে কক্ষ রয়েছে। তবে পূর্ব দিকের কক্ষগুলো চৌবাচ্চা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। হাম্মামখানার দক্ষিণ দিকে একটি চৌবাচ্চা ও সুড়ঙ্গ আছে। এটিকে তোশাখানা হিসাবে মনে করা হয়।
ধীরাজ ভট্টাচার্যের বাড়ি
কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়ায় প্রখ্যাত অভিনেতা ও সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্যের বাড়িও একটি দর্শনীয় স্থান। পুলিশের এই কর্মকর্তা ছিলেন সুসাহিত্যিক এবং অভিনেতা। নির্বাক থেকে সবাক-চলচ্চিত্রের দুটি মাধ্যমেই অভিনয়ের পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তিনি। তার পরিত্যক্ত বাড়িটিও দেখে আসতে পারেন ঈদের ছুটিতে।
এ ছাড়া ঐতিহাসিক যশোর রোডসহ শহর, শহরতলী এবং আশপাশের এলাকাগুলোতে আরও অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেগুলো ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। যশোর ছাড়াও আশপাশের জেলা নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা এবং খুলনা থেকেও প্রতিদিন এসব স্থানে দর্শনার্থীরা আসেন।

যশোর থেকে দেশের প্রায় ২৫টি রুটে নিয়মিত বাস সার্ভিস রয়েছে। নড়াইল, খুলনা ও ঝিনাইদহের একাংশের সাথে রয়েছে ট্রেন যোগাযোগ। ভ্রমণপ্রিয়রা সকালে এসে দিব্যি ভালোভাবে ঘোরাঘুরি করে ফিরে যেতে পারেন গন্তব্যে। কেউ থাকতে চাইলে আছে নানা মানের ভালো ভালো হোটেল।
