ঢাকা
সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

রোডক্র্যাশে বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ সহস্রাধিক

আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৪ পিএম

বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ রোডক্র্যাশে নিহত হন, যার প্রায় ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের ঘাটতি। মৃত্যুহার কমানোর বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দেশে এখনো কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হয়নি- এ অবস্থায় দ্রুত আইনগত ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বক্তারা।

সোমবার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘টেকসই উন্নয়নে সড়ক নিরাপত্তা আইন : বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ তথ্য জানান।

বক্তারা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশজনিত মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হলে এখনই একটি সমন্বিত ও কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) রোডক্র্যাশকে প্রতিরোধযোগ্য এক অসংক্রামক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা নীতি পরিবর্তন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের রোড সেফটি ইনজুরি অ্যান্ড প্রিভেনশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান। তিনি জানান, বিআরটিএসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ ঘটছে অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে।

তিনি বলেন, গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশনে উল্লেখিত ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ গতি, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং নিরাপদ যানবাহন নিশ্চিত করা গেলে হতাহত উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। বিশ্বের বহু দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণ করে মৃত্যুহার নামিয়ে এনেছে।

তিনি ২০২৩ সালের সিআইপিআরবি–ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, রোডক্র্যাশে আহতের বড়ো অংশ প্রথমে যান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে—যেখানে জরুরি সেবার সক্ষমতা সীমিত। হাসপাতালের শয্যার ১৬.২ শতাংশ এসব রোগীর জন্য ব্যবহৃত হয়। একজন রোগী গড়ে ১৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকেন এবং ওষুধ, পরিবহন, খাবার ও থাকা মিলিয়ে পরিবারকে বহন করতে হয় গড়ে ৩১ হাজার ৬৮৩ টাকা ব্যয়। এতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেমন চাপে পড়ে, তেমনি পরিবারও আর্থিক সংকটে পড়ে।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া তরুণরা বলেন, রোডক্র্যাশ এখন তরুণদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তারা স্মরণ করিয়ে দেন- মরক্কোয় অনুষ্ঠিত গ্লোবাল মিনিস্টেরিয়াল কনফারেন্সে বাংলাদেশ ২০২৭ সালের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা আইন এবং ২০২৬ সালের মধ্যে গতিসীমা ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা ও মানসম্মত হেলমেট গাইডলাইন প্রণয়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ধীরগতির। তাই দ্রুত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

এসময় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নিখিল কুমার দাস বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্ঘটনা শুধু মানবিক বেদনা বাড়ায় না, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশ ক্ষতি করে। তার মতে, পরিকল্পনাগত দুর্বলতা—বিশেষ করে কার্যকর ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং বাস্তবায়নে ব্যর্থতা- সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। কৃষিজমি রক্ষা ও জলাশয় সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিতে অসংগতি থাকার কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অনেক সময় উল্টো সড়কভিত্তিক ঝুঁকি বাড়ায়।

তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ, যেখানে বহু স্টেকহোল্ডার সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ এসডিজির দুটি ইন্ডিকেটর বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং ‘গ্লোবাল প্ল্যান ফর সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি’-এর সিগনেটরি দেশ হিসেবে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ গতি, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী, মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ও ল্যান্ড ইউজ প্ল্যানিং বাস্তবায়ন জরুরি।

নিখিল কুমার দাস আরও জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার একটি সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যার অর্থায়নে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে বিআরটিএ, সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর, ডিজি হেলথ ও বাংলাদেশ পুলিশ যুক্ত আছে। দুর্ঘটনার পর দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স বা পুলিশের ভ্যান পাঠিয়ে ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। যদিও উদ্যোগটি এখনো পর্যাপ্ত নয়, তিনি মনে করেন, ধাপে ধাপে এর সফল বাস্তবায়ন ভবিষ্যতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রজেক্টের (বিআরএসপি) প্রজেক্ট ম্যানেজার ডা. নুসায়ের চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের ডেটা সিস্টেম অত্যন্ত দুর্বল। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, ফলে পরিকল্পনা করা কঠিন হয়। বিভিন্ন সংস্থার সংখ্যায় বড়ো ধরনের পার্থক্য দেখা দেয়। যেমন- ২০২০ সালে পুলিশ বলেছে ৫ হাজার ৮৪ মৃত্যু, সংবাদভিত্তিক অনুমান ৬ হাজার, সিআইপি ২৩ হাজার, আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখিয়েছে ৩১ হাজার মৃত্যু। সড়ক নিরাপত্তায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হলে ডেটা সিস্টেম অবশ্যই আধুনিক করতে হবে।

তিনি বলেন, বিআরএসপি প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা নতুন তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু করছি। এর অংশ হিসেবে ১২ জেলায় ট্রমা রেজিস্ট্রি পাইলট হচ্ছে, যেখানে রিকশা থেকে হাইওয়ে পর্যন্ত সব ধরনের দুর্ঘটনার তথ্য এক প্ল্যাটফর্মে নথিভুক্ত করা হবে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য ছাড়া কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব, কারণ এতে একাধিক মন্ত্রণালয় ও ফাইন্যান্স জড়িত।

তিনি আরও বলেন, পোস্ট-ক্র্যাশ রেসপন্স শক্তিশালী করতে কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি) গঠন হচ্ছে। প্রতি ২০ কিলোমিটার পরপর অ্যাম্বুলেন্স, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং প্রশিক্ষিত ড্রাইভারসহ ২৪ ঘণ্টার জরুরি সেবা থাকবে। প্রথমে ২০০ কিলোমিটারের এলাকায় পাইলটিং হবে। যদি দেখা যায় যে কিউআরটি গোল্ডেন আওয়ারে দ্রুত সাড়া দিচ্ছে এবং মৃত্যু বা অক্ষমতা কমাতে পারছে, তাহলে এই সিস্টেম দেশজুড়ে স্কেল আপ করা হবে।

SN
আরও পড়ুন