ঢাকা
শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

ফেসবুকে সমালোচকদের দমনে ‘রিভিউ সিন্ডিকেট’

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৫ এএম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ চালানো হাজারেরও বেশি অ্যাকাউন্টের একটি সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে। ফেসবুকের ‘রিভিউ’ টুল ব্যবহার করে এই চক্রটি সমালোচকদের সুনামহানি এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডিসমিসল্যাব’-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় এই ‘অনলাইন মব’ বা সংঘবদ্ধ চক্রের বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা ১,১১৮টি ফেসবুক পেজে দেওয়া ৬২,৫২৯টি রিভিউ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, কীভাবে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে এই নেটওয়ার্ক পরিচালিত হচ্ছে।

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই নেটওয়ার্ক অন্তত ৭২১টি পেজকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। এদের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। হামলার শিকার পেজগুলোতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘ভুয়া তথ্য’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ বা ‘সামাজিক ক্ষতি’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে শত শত নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়।

বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে এমন পেজগুলোতে এই আক্রমণের তীব্রতা ছিল বেশি। উদাহরণস্বরূপ, সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’ শেখ হাসিনাকে নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেতিবাচক রিভিউয়ের শিকার হয়। একইভাবে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে ছবি পোস্ট করায় আক্রমণের মুখে পড়ে ‘দৃক’। এছাড়া যমুনা টিভি, দৈনিক আমার দেশ, স্টার নিউজ এবং প্রথম আলোর ‘হাল ফ্যাশন’ পেজেও হুবহু একই ভাষায় নেতিবাচক রিভিউ দিয়ে রেটিং কমিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ডিসমিসল্যাব নিজেরাও এই আক্রমণের শিকার হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেত্রী ড. তাসনিম জারার বিরুদ্ধে অনলাইন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই তাদের পেজে ‘রিভিউ বম্বিং’ শুরু হয়।

হামলাকারী অ্যাকাউন্টগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের অনেকের নাম বিভিন্ন খাবার বা মসলাজাত পণ্যের নামে রাখা। যেমন- রুটি বার্গার, সসেজ, চিকেন স্লাইস, ব্ল্যাক পেপার, মাশরুম স্যুপ ইত্যাদি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই ধরনের ১৯টি অ্যাকাউন্টসহ মোট ৬০টি মূল প্রোফাইল থেকে হাজার হাজার রিভিউ কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছিল মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে।

এই সংঘবদ্ধ চক্রটি কেবল নেতিবাচক রিভিউই দিচ্ছে না, বরং আওয়ামী লীগপন্থী পেজগুলোতে ইতিবাচক রিভিউ দিয়ে তাদের রেটিং বাড়াতেও কাজ করছে। একই অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যম (যেমন- এবিপি আনন্দ, রিপাবলিক বাংলা) এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক নেতার পেজেও প্রশংসা করে রিভিউ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিকভাবে এক পক্ষকে অবমূল্যায়ন করা এবং অন্য পক্ষকে মহিমান্বিত করাই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য।

গবেষণায় আওয়ামী লীগবিরোধী একটি ছোট নেটওয়ার্কেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় ২৪টি প্রোফাইল থেকে ‘বট লীগ’ বা ‘গুজব লীগ’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগপন্থী পেজগুলোতে নেতিবাচক রিভিউ দেওয়া হয়েছে। তবে মূল নেটওয়ার্কের তুলনায় এদের পরিসর ও কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সীমিত।

বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে ‘অনলাইন মব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ড. সুমন রহমান বলেন, ‘অনলাইনে ব্যবহারকারীরা সঠিক তথ্যের চেয়ে প্রথমে দেখা তথ্যকে গুরুত্ব দেয়। তাই সংঘবদ্ধ নেতিবাচক রিভিউ কোনো পেজ সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে।’

অনেক প্রতিষ্ঠান এই আক্রমণের মুখে তাদের রিভিউ অপশন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। মেটার নীতিমালায় সংঘবদ্ধভাবে ভুয়া রিভিউ দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও, এই নেটওয়ার্কের হাজার হাজার মন্তব্য এখনো ফেসবুকে দৃশ্যমান রয়েছে।

এই গবেষণাটি প্রমাণ করে যে, সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে জনমত গঠন এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একটি সুসংগঠিত ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা সক্রিয় রয়েছে, যা ডিজিটাল পরিসরে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য বড় হুমকি।

DR/SN
আরও পড়ুন