বাংলাদেশের অন্যতম পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে জীববৈচিত্র্য সম্মৃদ্ধশীল এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির নির্ভর ঐতিহ্যবাহী এলাকা হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা না থাকাসহ সৃজনশীলতার অভাবে প্রতিনিয়তই পাহাড় ন্যাড়া করে চলছে সনাতন পদ্ধতিতে জুম চাষ। ফলে গাছপালা, লতাগুল্মের সাথে উজাড় হচ্ছে বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখ-পাখালি।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এসব অবৈজ্ঞানিক কৌশল পাহাড় ধসেরও কারণ। আগুন দিয়ে জমি পরিষ্কারের কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পরিবেশ। প্রতি বছর মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে জুমচাষের জন্য নির্বাচিত পাহাড়ে আগুন লাগায় পাহাড়ি জুমিয়ারা। এরপর মাটি কুপিয়ে চাষের উপযোগী করা হয়। এমনভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পাহাড়ের জুম চাষ। এসকল কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যাড়া পর্বতগুলোই এখন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য আশঙ্কাজনকহারে কমেও যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই খাদ্যের অভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বুনোহাতি, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, পাহাড়ে এভাবে চাষাবাদের ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। এতে পাহাড়ের ক্ষয় হয়, মাটি উর্বরতা হারায়। বন ধ্বংসের কারণে পাহাড়গুলো নাজুক হয়ে পড়ে। তাই বর্ষা মৌসুমে বাড়ে পাহাড় ধসের শঙ্কা। তবে, পরিবেশের ওপর জুমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানেন না বেশিরভাগ জুম চাষি।

পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে জুম চাষিদের জুমের বিকল্প পদ্ধতি এখনো রাঙামাটির কৃষি বিভাগ দিতে না পারলেও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারে জুম চাষিদের প্রশিক্ষিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে বলে জানা গেছে।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, রাঙামাটিতে চাষকৃত জমির পরিমাণ ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর। তার মধ্যে ধানের আবাদ হয় ৫ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন হয় ৭৬৫০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, আদা হলুদের উৎপাদন হয় প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন। পাহাড়ি মারপা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, কচুসহ নানাবিধ সবজি হয় প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
তিনি জানান, সবমিলিয়ে রাঙামাটিতে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার মেট্রিক টন ফলন জুমের আওতায় থেকে পাওয়া যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা জানান, জুমচাষের বিকল্প কোনো উদ্যোগ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গ্রহণ করা হয়নি। তবে জুম চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে এটাকে কিভাবে মিনিমাইজ করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করছে রাঙামাটির কৃষি বিভাগ। জুম চাষের জন্য তৈরিকৃত জমিটি যাতে লম্বালম্বি না হয়ে আড়াআড়িভাবে করার জন্য এবং সার প্রয়োগের সময় যেন পাহাড়ের মাটির ব্যাপক ক্ষতি না হয় সেটি তুলে ধরে প্রান্তিক জুম চাষিদেরকে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ প্রদান করছি।
জুম চাষ নিয়ে কৃষি বিভাগ, বনবিভাগসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, দুর্গম পাহাড়ের বাসিন্দা জুমিয়া পরিবারগুলোর সারাবছরের খাদ্যের সংকুলান হয়ে থাকে জুম চাষের মাধ্যমে। অত্রাঞ্চলে এখনো পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আশানুরূপভাবে ঘটেনি। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলো উপজেলা সদরে আসতেই দু’থেকে তিন দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই স্থানীয় কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জুম চাষের বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে না। অত্রাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জুমের বিকল্প চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন করতে হবে অন্যথায় পাহাড়ের জুমিয়াদের সনাতন পদ্ধতির জুম চাষ থেকে ফেরানো যাবেনা।
রাঙামাটির কৃষি বিভাগ জানায়, প্রতি বছরের মতো এবারও এ অঞ্চলের জুম চাষিরা উচু পাহাড়গুলোতে অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফায়ার লাইন ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে অগ্নিসংযোগের কারণে এক পাহাড়ের আগুন অন্য পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। জুমিয়াদের লাগানো আগুনে শুধুই পাহাড়ের গাছপালা, জীববৈচিত্র্য পুড়ছে না স্থানীয় পাহাড়িদের ঘরবাড়ি এবং মানুষ পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। জুমের আগুনে সবুজ পাহাড়গুলো পোড়ানোর কারণে পাহাড়ে তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি টিকিয়ে রাখতে পার্বত্যাঞ্চলের জুমিয়াদের পরিবেশসম্মতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের পরামর্শ প্রধানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন পাহাড়ের সিনিয়র নাগরিকবৃন্দ।
