সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এক নতুন সম্পর্ক-সংক্রান্ত ট্রেন্ড ‘প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট’। চা-কফি বিছানায়, প্রতিদিন ফুল, পছন্দের খাবার অর্ডার করে দেওয়া, স্পা বা পার্লারে সঙ্গীর খরচে যাওয়া। এইসব রূপকথার রাজকন্যার মতো আচরণ বা ‘ট্রিটমেন্ট’ এর ভিডিও ও ছবি এখন ভাইরাল হয়ে উঠছে টিকটক-ইনস্টাগ্রামে।
তবে প্রশ্ন উঠছে এটা কি নিছক এক ফ্যান্টাসি? সম্পর্কের প্রতি যত্নের নতুন উপায়? নাকি পুরনো পিতৃতান্ত্রিক রূপে নারীদের নির্ভরশীল করে তোলার আধুনিক মোড়কে উপস্থাপন?
রূপকথা থেকে রিয়েল লাইফে ‘প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট’
ধারাবাহিক Bridgerton, The Gilded Age কিংবা The Buccaneers-এ যেমন উচ্চবিত্তদের সৌখিন প্রেম দেখা যায়, ঠিক তেমনই এক রোমান্টিক সৌজন্যপূর্ণ প্রেম এখন বাস্তব জীবনে চর্চিত হচ্ছে #princesstreatment হ্যাশট্যাগের অধীনে। ইনস্টাগ্রামে এই হ্যাশট্যাগে রয়েছে প্রায় ১.৩ লক্ষ পোস্ট।
এই ট্রেন্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন কোর্টনি পামার, একজন আমেরিকান ইনফ্লুয়েন্সার, যিনি নিজেকে বলেন প্রিন্সেস হাউসওয়াইফ। তার এক টিকটক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি রেস্তোরাঁয় গেলে স্বামী ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলেন না, নিজের খাবার নিজে অর্ডারও করেন না। ভিডিওটি দেখা হয়েছে ৭.৬ মিলিয়নেরও বেশি বার।
সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, এটি স্বাধীনতা নয়, বরং ক্যামেরাবন্দি নিঃস্বতা। The Guardian-এর এমা বেডিংটন একে বলেছেন অস্বস্তিকর এবং বিকৃত রকমের পুরাতনপন্থী।
কেন জনপ্রিয় হচ্ছে এই ট্রেন্ড?
মাইকা মেইয়ার, এক জনপ্রিয় এটিকেট ইনফ্লুয়েন্সার বলেন, ডেটিং এখন অনেক সময় লেনদেনের মতো হয়ে গেছে। এর মাঝে কেউ যদি সত্যি মনোযোগ দিয়ে আচরণ করে, সেটা বিশেষ কিছু মনে হয়। তার মতে, এটা শুধুই বিলাসিতা নয়, বরং উদ্দেশ্যমূলক সম্মান ও যত্ন।
আর ড্যানিয়েল পোস্ট সেনিং, আধুনিক এটিকেটবিষয়ক লেখক এবং Emily Post-এর বংশধর, মনে করেন, পুরনো দিনের রাজকীয় প্রেমের গল্পগুলো এখনকার প্রজন্মের রোমান্টিক ভাবনার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, আমরা গল্প দিয়ে আমাদের আবেগকে বোঝার চেষ্টা করি।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজকন্যাদের প্রতি মুগ্ধতা
ইতিহাসবিদ আরিয়ান চেরনক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজপরিবার না থাকলেও রাজকন্যা বা রাণীদের নিয়ে একধরনের দীর্ঘদিনের মোহ রয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে ওয়ালিস সিম্পসন, পরে প্রিন্সেস ডায়ানা কিংবা মেগান মার্কেল সবাই এই আকর্ষণকে আরও তীব্র করেছে।
চেরনক বলেন, প্রিন্সেস ফিগার মার্কিন নারীদের কাছে এমন এক মিশ্র প্রতীক যেখানে সৌন্দর্য, শক্তি, স্টাইল এবং মানবিকতার সংমিশ্রণ রয়েছে।
আত্মবিশ্বাস নাকি গোপন পিতৃতন্ত্র?
সমালোচকদের মতে, প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট এমন এক পুরাতন চিভ্যালরি (knightly etiquette) ধারণাকে ফিরিয়ে আনছে, যা অনেক সময় ‘benevolent patriarchy’ অর্থাৎ ‘মায়াবী পিতৃতন্ত্র’-এর মাধ্যম হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, এটি এমন এক সৌজন্য যা নারীকে পেছনে ফেলে পুরুষের আধিপত্য ধরে রাখে।
তবে এর বিপরীতে মেইয়ার বলেন, কাউকে চেয়ারে বসতে দেওয়া বা বাসায় পৌঁছে দেওয়া মানেই আধিপত্য নয়, বরং আন্তরিকতার প্রকাশ।
ইতিহাসবিদ চেরনক বলেন, প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট বিষয়টি আদতে দীর্ঘদিন ধরে নারীর ভূমিকা নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এটি মূলত নারীত্ব, আকাঙ্ক্ষা ও প্রথার একটি বহুমাত্রিক আলোচনা যার একক ব্যাখ্যা নেই।
ট্র্যাডওয়াইফ থেকে প্রিন্সেস: নতুন মোড়কে পুরনো বিতর্ক?
এই ট্রেন্ড আসছে ঠিক সেই সময়, যখন সামাজিক মাধ্যমে ট্র্যাডওয়াইফ (Trad Wife) আন্দোলন জোরালো। ঘরকেন্দ্রিক, পুরনো আদর্শে নারীর জীবনযাপন এই কনটেন্টও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বহু তরুণীর কাছে।
Rolling Stone সম্প্রতি প্রশ্ন তোলে, প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট কি ট্র্যাডওয়াইফ আন্দোলনের ‘গেটওয়ে ড্রাগ’? অর্থাৎ, এটি কি আরও বেশি রক্ষণশীলতা ও নির্ভরশীল জীবনের পথে এক ধাপ মাত্র?
তবে চেরনক মনে করিয়ে দেন, ছোট মেয়েরা যখন রাজকন্যা হতে চায়, তখন তারা শক্তি ও প্রভাবের ভূমিকাতেই খেলছে। তার ভাষায়, অনেক সময় তারা অনুমতি চায় শক্তিশালী হতে, আবার কখনও হয়তো দরকারই হয় না। কারণ এই ট্রেন্ড যেহেতু নারীরাই চালাচ্ছেন, তার মানে, নিয়ন্ত্রণও নারীরাই রাখছেন।
প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট রূপকথা, প্রতিবাদ নাকি পুনরুত্থিত পিতৃতন্ত্র?
প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট একদিকে একটি রোমান্টিক জীবনধারার স্বপ্ন, আবার অন্যদিকে নারীর ভূমিকা নিয়ে সমাজের দীর্ঘ বিতর্কের নতুন সংস্করণ। এটি একেক জনের কাছে একেক অর্থ বহন করে স্বাধীনতার প্রকাশ, আদর খোঁজার আকাঙ্ক্ষা, অথবা নিছকই একটি মজাদার ফ্যান্টাসি।
তবে বিতর্ক একটাই আপনি আসলেই রাজকন্যা কিনা, সেটা কি আপনি ঠিক করছেন? নাকি কেউ আপনাকে সেই ভূমিকায় বসিয়ে রাখছে?
