কাজী মোতাহার হোসেন (জন্ম : ৩০ জুলাই ১৮৯৭- মৃত্যু : ৯ অক্টোবর ১৯৮১) ছিলেন একজন বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ ও সাহিত্যিক। কাজী মোতাহার হোসেনের পৈতৃক বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তবে তার জন্ম কুষ্টিয়া (তখনকার নদীয়া) জেলার কুমারখালী থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে তার মামাবাড়িতে ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই। তার বাবা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ ছিলেন সেটেলমেন্টের আমিন। মায়ের নাম তাসিরুন্নেসা। শৈশব কাটিয়েছেন পাংশার বাগমারায়। ১৯২১ সালে এম. এ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমানের কন্যা সাজেদা খাতুনের (১৯০৫ -১৯৭৫) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের সংসারে চার পুত্র ও সাত কন্যা ছিলেন। তারা হলেন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাজী মাহবুব হোসেন।
কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুষ্টিয়াতেই। মেধাবি ছাত্র হিসাবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি ও ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাস করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথমস্থান অর্জন করে মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিলাভ করেন। ঢাকা কলেজে তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়াল্টার অ্যালেন জেনকিন্স, পদ্মভূষণ ভূপতি মোহন সেন, ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাস করেন।
উল্লেখ্য, সেবছর কেউ প্রথম শ্রেণি পাননি। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। যুগপৎভাবে, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পি.এইচ.ডি করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল `Design of Experiments।’ তার ডক্টরাল থিসিসে তিনি `Hussain’s Chain Rule’ নামক একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেন। বস্তুত, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশ) তিনিই প্রথম স্বীকৃত পরিসংখ্যানবিদ।
১৯২১ সালে ঢাকা কলেজে ছাত্র থাকাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রদর্শক হিসেবে চাকরি শুরু করেন এবং একই বিভাগে ১৯২৩ সালে একজন সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। কাজী মোতাহার হোসেনের নিজ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে এম. এ. কোর্স চালু হয় এবং তিনি এই নতুন বিভাগে যোগ দেন। তিনি গণিত বিভাগেও ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পরিসংখ্যানে একজন রিডার ও ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে স্থাপিত পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষা ইনস্টিটিউটের তিনি প্রথম পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
তার লেখা বইগুলোর মধ্যে সঞ্চয়ন (১৯৩৭) (প্রবন্ধ সংকলন), নজরুল কাব্য পরিচিতি (১৯৫৫), সেই পথ লক্ষ্য করে (১৯৫৮), সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোক বিজ্ঞান (১৯৭৪), নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৭৬), প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ-১৯৬৫) অন্যতম। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে। কাজী মোতাহার হোসেন ভবন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের নতুন নামকরণ করা হয়।
১৯২৫ সালে নিখিল ভারত দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যাপারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি।
তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবা খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে তাকে সম্মানিত করা হয়। দাবা খেলায় তার অনন্য অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের উদ্যোগে কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
