প্রথমবারের মতো পোস্টারবিহীন সংসদ নির্বাচন

আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০৪ পিএম

বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি হতে যাচ্ছে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে এবারই প্রথমবারের মতো কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল ভোটের প্রচারণায় পোস্টার ব্যবহার করতে পারবেন না। পরিবেশ রক্ষা এবং প্রচারণায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

একসময় বাড়ির দেয়াল, রাস্তা, বাজার কিংবা গাছে প্রার্থী ও দলের নাম প্রতীকসংবলিত পোস্টারই ছিল নির্বাচনি প্রচারণার প্রধান অনুষঙ্গ। তবে আসন্ন নির্বাচনে সেই চিত্র আর থাকছে না। পোস্টারের পাশাপাশি প্রচারণায় লিফলেট ও ব্যানারে প্রার্থী ও দলীয় প্রধান ছাড়া অন্য কারও ছবি ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, পরিবেশ সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই পোস্টার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, পোস্টার লেমিনেটিংয়ের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং কালি ফসলের ক্ষতি করে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচনি প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আলাদা করে বেশ কিছু ধারা যুক্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো একটি টেলিভিশন সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন তফসিল ঘোষণার আগেই চূড়ান্ত করা হলেও, তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধি মানাতে কমিশন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এরই মধ্যে বিধি ভেঙে প্রচারণায় অংশ নেওয়ায় দেশের কয়েকটি স্থানে জরিমানার ঘটনাও ঘটেছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসরণ করে গত বছরের নভেম্বরে ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’ চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশন। এরপর গত ১০ নভেম্বর আচরণবিধিতে সংশোধন এনে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচন থেকে ভোটের প্রচারণায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা কোনো ধরনের পোস্টার ব্যবহার করতে পারবেন না। ফলে বাংলাদেশে এই প্রথম পোস্টার ছাড়া জাতীয় নির্বাচনি প্রচারণা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিধিমালা চূড়ান্ত করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নিয়েছি। একটি মাত্র রাজনৈতিক দল বাদে বাকি কোনো দলই এ নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি।’ তিনি জানান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন আগেই পোস্টার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল।

পোস্টার নিষিদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইসি সচিব বলেন, পরিবেশগত দিকটিও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। তার ভাষায়, ‘পোস্টার ছাপানোর পর অনেক প্রার্থী সেগুলো লেমিনেটিং করে, যা পরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পোস্টারের কালি ফসলের মাঠের ক্ষতি করে। সব দিক বিবেচনায় নিয়েই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী নির্বাচনে কেউ পোস্টার ব্যবহার করতে পারবে না।’

তবে পোস্টার বন্ধ হলেও প্রার্থীরা লিফলেট, হ্যান্ডবিল ও ফেস্টুন ব্যবহার করতে পারবেন। তবে এসব প্রচারণা সামগ্রী কোনো দালান, দেয়াল, গাছ, বেড়া, বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের খুঁটি, সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের স্থাপনা কিংবা কোনো যানবাহনে লাগানো যাবে না। নির্বাচনি প্রচারণা পত্র, বিলবোর্ড বা ফেস্টুনে রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে দলীয় প্রধান ছাড়া অন্য কারও ছবি ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আখতার আহমেদ বলেন, ‘অনেক সময় একজনের পোস্টারের ওপর আরেকজনের পোস্টার লাগানো নিয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়। এসব বিষয় বিবেচনা করেই আচরণবিধিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।’

নির্বাচনি প্রচারণায় যানবাহনের ব্যবহারেও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও, প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত প্রচারণা চালানোর সুযোগ নেই। তবু তফসিল ঘোষণার পর চট্টগ্রাম-১৫ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নাজমুল মোস্তফা আমিন মোটরসাইকেল ও গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন করায় নির্বাচন কমিশন তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে।

এ প্রসঙ্গে ইসি সচিব বলেন, ‘আমরা তাকে সতর্ক করেছিলাম। এরপরও একই অপরাধ তিনি দুইবার করেছেন। সে কারণেই কমিশন আইনের প্রয়োগ করেছে।’

সংশোধিত আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনি প্রচারণায় কোনো বাস, ট্রাক, নৌযান, মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো যান্ত্রিক বাহনসহ মিছিল, জনসভা কিংবা শোডাউন করা যাবে না। যানবাহনসহ বা যানবাহন ছাড়া কোনো ধরনের মশাল মিছিলও নিষিদ্ধ। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ও কোনো মিছিল বা শোডাউন করা যাবে না। ভোটের দিন যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এসব বিধান ভঙ্গ করলে প্রার্থীদের আর্থিক দণ্ড দেওয়া হতে পারে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রার্থিতা বাতিলের ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সংশোধিত বিধিমালায় বলা হয়েছে, প্রার্থী, তার নির্বাচনি এজেন্ট বা সংশ্লিষ্ট দলকে প্রচারণা শুরুর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইলসহ সব সনাক্তকরণ তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হবে।

প্রচার-প্রচারণা বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ভুল তথ্য, কারও চেহারা বিকৃত করা, নির্বাচন সংক্রান্ত বানোয়াট তথ্য বা ক্ষতিকর কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ, নারী, সংখ্যালঘু বা কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা উস্কানিমূলক ভাষা ব্যবহারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ। সত্যতা যাচাই ছাড়া নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার বা প্রকাশ করা যাবে না বলেও বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে।

সংশোধিত আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য কিংবা কোনো প্রার্থী বা ব্যক্তির চরিত্র হনন বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে সাধারণভাবে, সম্পাদনা করে বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোনো মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতমূলক, বিদ্বেষপূর্ণ, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ বা মানহানিকর কনটেন্ট তৈরি করতে পারবেন না।’

ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘আমরা আইনের প্রয়োগের বিষয়ে সতর্ক। যিনিই আচরণবিধিমালা ভাঙবেন, তার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

NB/FJ
আরও পড়ুন