সময় বদলায়, বদলায় প্রযুক্তি আর যানের রূপ। বাংলাদেশের রাস্তায় একসময়ের ‘মুড়ির টিন’ খ্যাত জীর্ণশীর্ণ বাসগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়। তাদের জায়গা দখল করেছে চকচকে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক বাস। এই বাহ্যিক রূপান্তর নিঃসন্দেহে চোখ ধাঁধানো। কিন্তু মৌলিক একটি প্রশ্ন থেকে যায়— বাসের চেহারা বদলালেও যাত্রীসেবার মানে এসেছে কি ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন? দুর্ভাগ্যবশত, এর জবাব হচ্ছে— না। বাহ্যিক এই বিবর্তনের আড়ালে যাত্রীসেবায় রয়ে গেছে গভীর এক স্থবিরতা।
বাসের শরীর বদলালেও এর ভেতরের ‘সংস্কৃতি’ বা ‘মনোভাব’ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। এখনো চালক ও হেলপারদের একটি বড় অংশ যাত্রীকে শুধু একটি ‘ভাড়ার উৎস’ বা ‘মালামাল’ হিসেবে দেখে। যাত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা, সদয় ব্যবহার বা সেবাদানের মনোভাবের খুবই অভাব। মুড়ির টিনের যুগের মতো আজও ভাড়া নিয়ে হয়রানি থামেনি। যাত্রীর অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া, খুচরা টাকা ফেরত না দেওয়ার মতো ঘটনা প্রায়শ ঘটে। বাসের গতি ও শক্তি বেড়েছে কয়েক গুণ; কিন্তু চালকের দায়িত্ববোধ বাড়েনি। বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, বাস স্টপেজে না থামিয়ে যত্রতত্র থামানো— এসবের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমেনি; বরং আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যাত্রীর জীবন এখনো ‘সস্তা’। সময়সূচি না মানা, নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডে না দাঁড়ানো, যাত্রী কম থাকলে রুট পরিবর্তন করা— এ রকম অনিয়ম এখনো নিয়মিত ঘটনা।
ধরুন, সকাল ৭টা। অফিসের সময় ৮টা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই মনে একটা হিসাব কষতে হয়— আজকে বাস মিলবে কতক্ষণে? রিকশা না-কি অটো? পথে কী পরিমাণ যানজটে আটকে যাবো? এই অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তি ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর লাখো মানুষ প্রতিদিনের জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে। গণপরিবহন, যা হওয়ার কথা ছিল নাগরিক চলাচলের সহজ ও সাশ্রয়ী মাধ্যম, তা আজ নিজে হয়ে দাঁড়িয়েছে দুঃস্বপ্নের কারণ।
যেকোনো কর্মদিবসের সকাল বা সন্ধ্যায় একটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ালে চোখে পড়বে বাস্তবতার করুণ চিত্র। নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া অকারণে থামা, যাত্রী থাকা সত্ত্বেও গতি কমিয়ে চালকের ‘সময় কাটানো’, ভাড়া আদায়ে সহকারী বা হেলপারের রূঢ় আচরণ— এগুলো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাসের ভেতরের দৃশ্য আরও ভয়াবহ। নির্ধারিত সিটের দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে বাস ছোটে। জানালা দিয়ে ঝুলে কিংবা ফুটবোর্ডে পা রেখে চলাচল করতে হয় অনেককে। গরমের দিনে ভেতরের দমবন্ধ পরিবেশ সহ্য করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু বাস নয়, রিকশা এবং অটোরিকশাও কম ভোগান্তি তৈরি করে না। দরদামের এক অন্তহীন লড়াই, রাস্তার মাঝখানে অপ্রত্যাশিতভাবে থামা, যানজট তৈরি করা এবং অনেক সময় নির্দিষ্ট গন্তব্যে না যাওয়ার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যাত্রীদের। লঞ্চযাত্রীদের ভোগান্তিও কম নয়। সঠিক সময়ে ছাড়া, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি— সব মিলিয়ে প্রতিটি যাত্রা যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ।
বিভিন্ন গবেষণা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এই ভোগান্তির পরিমাণগত চিত্র তুলে ধরে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাসযাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে গড়ে দৈনিক অতিরিক্ত ৬০ থেকে ৯০ মিনিট ব্যয় করতে হয় শুধু যানজট ও পরিবহনের অনিয়মের কারণে। এটি সপ্তাহে প্রায় ৫-৭ ঘণ্টা এবং মাসে একটি পূর্ণ কর্মদিবসের সমান মূল্যবান সময়ের অপচয়।
ব্র্যাকের এক জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীর ৭০ শতাংশেরও বেশি বাসযাত্রী পরিবহন কর্মীদের রূঢ় আচরণের শিকার হন। এছাড়া, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, শুধু ২০২৩ সালে গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। ভাড়া আদায়ে অসাধুতা আরেকটি বড় সমস্যা। অনেক রুটে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করা হয়, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বাড়তি আর্থিক বোঝা।
এ দুরবস্থার জন্য একাধিক কারণ দায়ী। প্রথমত; অপর্যাপ্ত ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা। শহরের চাহিদার তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা নগণ্য। যা আছে, তার সুষ্ঠু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণেরও অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত; নিয়মকানুনের অবমাননা। ট্রাফিক আইন ও যানবাহন পরিচালনার বিধিবিধান অনেকক্ষেত্রে কাগুজে বুলি হয়ে থাকে। তৃতীয়ত; দায়িত্বহীনতা ও লাভের অদম্য স্পৃহা। পরিবহন মালিক ও চালকদের একটি অংশ শুধু মুনাফা সর্বোচ্চকরণের নেশায় যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তাকে তুচ্ছজ্ঞান করে। চতুর্থত; অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। সংকীর্ণ রাস্তা, ফ্লাইওভার ও বিকল্প রুটের অভাব যানজটকে বাড়িয়ে দেয়, যা পরিবহন ভোগান্তিকে ত্বরান্বিত করে।
এই জটিল সমস্যার সমাধান হতে পারে। যেমন—
১. সুষ্ঠু ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা : পরিবহন সেক্টরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, সময়সূচি অনুসরণ নিশ্চিতকরণ এবং যানবাহনের যান্ত্রিক সক্ষমতা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম (সিসিটিভি, জিপিএস) চালু করে বাসের অবস্থান ও গতি নজরদারি করা যেতে পারে।
২. সেবার মান ও দক্ষতা বাড়ানো : চালক ও হেলপারদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে সেবাদান, শিষ্টাচার ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হবে। তাদের জন্য ন্যায্য বেতন ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করলে তারা শুধু ভাড়া আদায়ের ওপর নির্ভরশীল হবে না।
৩. পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ : শহরে পর্যাপ্ত সংখ্যক আধুনিক, আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব বাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা (বিআরটি, মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ) নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিত করতে হবে। সমন্বিত টিকিটিং ব্যবস্থা চালু হলে যাত্রীদের জন্য ভাড়া পরিশোধ সহজ হবে।
৪. নাগরিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ : যাত্রীদেরও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা না দেওয়া, অসদাচরণের প্রতিবাদ করা এবং কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানানোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
গণপরিবহন শুধু একটি যাতায়াতের মাধ্যম নয়, এটি একটি শহরের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও নাগরিক জীবনমানের ব্যারোমিটার। প্রতিদিনের এই ভোগান্তি শুধু সময় নষ্ট করছে না, এটি আমাদের সম্মিলিত উৎপাদনশীলতা, মানসিক শান্তি ও সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। এই সমস্যার সমাধান শুধু পরিবহন খাতের উন্নয়ন নয়, এটি একটি সুশাসিত, সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর গড়ার অঙ্গীকার। সরকার, পরিবহন মালিক সমিতি, চালক এবং সাধারণ নাগরিক— সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই অদৃশ্য যুদ্ধ থেকে মুক্তি মেলা সম্ভব নয়। আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর ও কর্মপ্রয়াস কেবল এই যাত্রাপথকে যন্ত্রণা থেকে অনুভূতিতে পরিণত করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
