তিন দিনের সফর শেষে ঢাকা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। টানা দুইদিন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন তিনি। এই সফরে তিনি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকটি বৈঠক এবং মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। তবে দুদিনের সফরে শুধু বিএনপি নয়; সমমনা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেননি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছর ডোনাল্ড লুর সফর ছিল বেশ আলোচনায়। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন করা বিএনপি তখন বেশ চাঙা হয়ে উঠেছিল। তবে লু’র এবারের সফর ঘিরে উৎসাহ ছিল না বিএনপির। দলটির মহাসচিব বলছেন, কে এলো আর কে গেল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে এ সফর গুরুত্বপূর্ণ।
লু’র আসার খবরে বিএনপি চাঙা হয়েছে-ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এমন দাবি তুললেও এ বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দেননি বিএনপির নেতারা। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে লু’র সফর নিয়ে বিএনপির যে উচ্ছ্বাস ছিল; এবার তার বিন্দুমাত্র ছিল না। এ সফরের আলোচনাও দলটির দায়িত্বশীল নেতারা এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ডোনাল্ড লুর আগমন নিয়ে আমরা কেউ ইন্টারেস্টেড নই। আমাদের ভরসা জনগণের ওপর, সেই আস্থার ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ কারো ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনবে- এটা আমরা মনে করি না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, আমাদের কাছে লু অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; যতটা গুরুত্বপূর্ণ কুকি-চিনের আক্রমণ। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। ডোনাল্ড লু তো অনেক দূরের মানুষ। আমরা শঙ্কিত আমাদের নিজের দেশের অবস্থা নিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের সমস্যা সব সময়ে নিজেরা করেছে। ৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ আমরাই করেছি। যারা মানুষের ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন করতে চায়, আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই; আর কেউ বিরোধিতা করলে নিন্দা জানাই।
তবে দলের বৈদেশিক নীতি দেখেন এমন এক নেতা জানান, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে সংলাপ ইস্যুতে ডোনাল্ড লুর ভূমিকায় হতাশ। বিএনপি ধারণা করেছিল, সংলাপে বসতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেবেন ডোনাল্ড লু। দায়িত্ব পাওয়ার পর চারবার বাংলাদেশ সফর করেছেন লু। সবশেষ গত বছরের জুলাইয়ে এসেছিলেন তিনি। জাতীয় নির্বাচনের আগে তার সেই সফর নিয়ে বিএনপিতে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপে বিএনপি বিশেষ সুবিধা পাবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের কথায়ও এমন মনোভাবের বিষয়টি তখন ফুটে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি। নির্বাচনের আগে ওই সফরে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার গঠিত হয়। সেই ভোট হয়ে যাওয়ার চার মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফের আসেন ঢাকায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাছাড়া নানা কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই দলটি নিজেদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবমুক্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। আপাতত চুপ থেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
গত সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে প্রশ্ন করা হয়। ১৭ মাসের মধ্যে তৃতীয়বার তার এই সফরে তিনি রাজনৈতিক দল কিংবা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করবেন কিনা- সে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতে বারবার কথা বলা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে কিনা- সেই প্রশ্নও রাখা হয় বেদান্ত প্যাটেলের কাছে। তবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় নেই। ব্যস্ততার কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন না ডোনাল্ড লু।
ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘প্রলাপ বকছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, লু’র সফর নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা কোথাও কোনো কথা বলেননি। অথচ ওবায়দুল কাদের সাহেব প্রতিদিন এ নিয়ে প্রলাপ বকছেন।
ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফরে বিএনপি উৎসাহী নয় বলে মন্তব্য করেছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। তিনি বলেন, লু কী বার্তা নিয়ে এসেছেন, সেটা সরকারি দল জানে, আমাদের জানার কথা নয়। কারণ অবৈধভাবে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ বসে আছে।
মঙ্গলবার ঢাকা পৌঁছে ডোনাল্ড লু নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মীদের সাথে বৈঠক করেন। রাতে, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে বৈঠক করেন। সেখানেই ছিলো নৈশভোজের আয়োজন। বুধবার তিনি পররাষ্ট্র সচিব, পরিবেশ মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। যৌথ ব্রিফিংয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র।
