ঢাকা
মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে সরকার

অর্থনীতিতে টাকা পাচার রোধ, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ মোকাবেলা, রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক অভিঘাত হলো বড় চ্যালেঞ্জ

আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৮:২৪ পিএম

দেশের আর্থিক খাতে অস্থিরতা দীর্ঘদিনের। ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান। বাণিজ্য ঘাটতি স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি হয়েছে এই সময়ে। ইচ্চাকৃত ঋণখেলাপিতে তারল্য সংকটে দেশের ব্যাংক খাত। নামে-বেনামে ঋণ, জাল-জালিয়াতি ও পারিবারিক আধিপত্যে খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। সরকারি সব দফতের চলছে ঘুষ আর দুর্নীতির রমরমা বাণিজ্য। অর্থপাচার তো এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের টাকায় বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন অনেক বাংলাদেশি। এ ছাড়া মুদ্রাবাজার, পুঁজিবাজার এবং বীমা খাতেও রয়েছে বিশৃঙ্খলা। এসব কারণে গত কয়েক বছর ধরে কোনোভাবেই বিনিয়োগ কাঙ্খিত হারে বাড়ছে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আর্থিক খাতে স্বচ্চতা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আগাচ্ছে সরকার। যার প্রমাণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বিরোধী অবস্থানকে সামনে আনা হচ্ছে। 

দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান

সম্প্রতি সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের বিপুল সম্পদের খোঁজ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুধু দেশেই নয় বিদেশেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় আগাচ্ছে সংস্থাটি। এরপর আলোচনায় আসে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। বলা হচ্ছে আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে বেনজির অনেকটাই শিশুর মতো। অর্থাৎ বেনজির এর চেয়ে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক এই ব্যাক্তি। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তার ছেলের ছাগল কেনাকে কেন্দ্র করে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিলো কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ। শুধু দেশেই নয় এই কর্মকর্তা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বিদেশেও। তার বিরুদ্ধেও আইনি প্রক্রিয়া আগাচ্ছে সরকার। 

সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের এমন সম্পদের তথ্য দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক সংসদ সদস্য। খোদ সংসদেও এ নিয়ে হয়েছে আলোচনা। দাবি উঠেছে এসব অসাধু কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে আর্থিক খাতের সৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। এর আগে, নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয় ব্যাংকসহ আর্থিকখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সংসদে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি করলে রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সুতরাং অর্থ পাচার আর আর্থিক কেলেংকারির সাথে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে সেটা জোরদারভাবেই শুরু হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি যেখানেই হোক তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নির্দিষ্ট একটা দলের জন্য না, এটা সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই বার্তা।

অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, আর্থিকখাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে পরিশোধ, নিকাশ ও  নিষ্পত্তি ব্যবস্থা সংহতকরণ, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের ঝুঁকি হ্রাস করাসহ গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিধান প্রণয়নকল্পে জাতীয় সংসদে পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিল ২০২৪ পাস করা হয়েছে। মূল্যায়ন স্টেক হোল্ডারদের নিকট তুলে ধরতে অর্ধ-বার্ষিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ সিস্টেমিক রিস্ক ড্যাসবোর্ড প্রণয়ন করা হয়েছে। ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আওয়তায় ব্যাংকসমূহের জন্য সংরক্ষিতব্য মূলধনের পরিমাণ বাড়নোর পাশাপাশি মূলধনের গুনগত মান বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা করেছে। 

ব্যাংকিং খাত নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২১ জুন ২০২৩ তারিখে  ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশধন) আইন ২০২৩ ‘ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন-২০০০’ সংশোধনপূর্বক ‘আমানত সুরক্ষ আইন-২০২৩’ প্রণীত হয়েছে। মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং ‘পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারঃ আইনি কাঠামো ও কৌশলগত প্রক্রিয়া গাইডলাইন অনুমোদিত হয়েছে।

তবে দুয়েকটা দুনীতি বিরোধী অভিযানকে দুর্নীতি কমানোর জিরো টলারেন্সের উদাহরণ হিসেবে নিতে চান না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনেকেই বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান দেখা যাচ্ছে তারা চুনোপুটি মাত্র। আড়ালে লুকিয়ে আছে রাঘববোয়ালরা।  বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তেমন কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সরকার। যে পরিমান দুর্নীতি হচ্ছে দেশে তার বিরুদ্ধে সরকার কিছুই করতে পারেনি। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এত বড় রকমের দুর্নীতি কেউ করার সাহস পায় না। অভার নাইট তো কেউ হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করতে পারে না, এটা দীর্ঘদিন ধরে হয়েছে। এই রাজনীতি দিয়ে এর সমাধান হবে না। সরকার এবং রাজনীতি দুটোই পঁচে গেছে।


বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন দৈনিক খববর সংযোগ করে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে সবই হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। বাইরের জমির দামের চেয়ে শিল্প এলাকার জমির দাম রাখা হচ্ছে অনেক বেশি। অনেক এলাকায় আবার পানির ব্যবস্থাও নেই। শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার পর তাদের মনে হয়েছে এখানে তো পানি নেই। তাহলে কারখানা চলবে কীভাবে সেখানে?  তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বাড়তি খরচ দিতে হবে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে বিনামূল্যে জমি দেওয়া হচ্ছে, নামমাত্র পানি ও গ্যাসের দাম রাখছে, ব্যবসাবান্ধব ভ্যাট-ট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে। যেখানে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা সেখানে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে বিনিয়োগকারীরাও আগের মতো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধুমাত্র দেশি বিনিয়োগকারী না বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আসছে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারী টানতে সব ধরণের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। যেখানে বিনিয়োগবান্ধব সব ধরণের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে সরকার। 


প্রযুক্তিগত পরিসেবা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে ইন্টারনেট সেবার মান উন্নয়ন করা হচ্ছে দেশে সেভাবে হচ্ছে না। বরং যে সেবাগুলো চলমান আছে তাতেও খরচ বাড়ছে ব্যাবসায়ীদের। সাইবার নিরাপত্তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ হারিয়ে গেছে প্রযুক্তি দুর্বলতার কারণেই। তবে ইন্টারনেট নির্ভর সেবাকে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। তিনি বলছেন, ইন্টারনেট সেবা আগের চেয়ে ভালো করার কাজ চলছে। এদিকে ই-ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন  দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট স্পীড। কিন্তু সেদিক থেকে তাদেরকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। তারা বলছেন, শহরে কিছুটা স্পীড থাকলেও গ্রামে নেই বললেই চলে।

অর্থনীতি বিশ্লেষক মাজেদুল হক দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, যে ১১ বিষয় গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ, সেখানে অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটানোর কঠোর কোনো বার্তা নেই। দেশের ব্যাংক থেকে শুরু করে পুরো আর্থিক খাতে যে ধরণের অরাজকতা চলছে তা নিরসনে কঠোর থেকে কঠোর হওয়ার বার্তা দেওয়ার দরকার ছিলো তা কিন্তু নেই। এ ইশতেহার পুরোপুরি বাস্তবায়ণ করা গেলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে কিন্তু সঙ্কট কাটবে না। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবে মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতিতে টাকা পাচার রোধ, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ মোকাবেলা, রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক অভিঘাত হলো বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যপণ্যের মূল্য যে হারে বাড়ছে, তা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি থাকা মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। 

SM/WA
আরও পড়ুন