ঢাকা
শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন 

দীর্ঘ অপেক্ষার পর সরকার সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। বাপা থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, বছরে ৫০ হাজার টন রপ্তানি ও প্রতি কেজির রপ্তানির দর ১ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার নির্ধারণের জন্য।

আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৩৭ পিএম

সরকার সুগন্ধি চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিশ্ব বাজার হারিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত সুগন্ধি চাল বিশেষ দিন ছাড়া বিক্রি নেই। ফলে এই চাল উৎপাদনকারী কৃষকরা নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। দেশের রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সুগন্ধি চাল ভারতে পাচার হচ্ছে। এসব চাল ভারতীয় কিছু অসাধু রপ্তানিকারক এ দেশ থেকে চোরাই পথে নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করে বিদেশে রপ্তানি করছে।

গত ২২ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় সুগন্ধি চাল রপ্তানি খুলে দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সুগন্ধি চালের রপ্তানিমূল্য ও পরিমাণ নির্ধারণে ১১ সদস্যের একটি নতুন কমিটি করা হয়। তারা রপ্তানি উন্মুক্ত করতে সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। এই সিদ্ধান্তের পর সরকার সুগন্ধি চাল রপ্তানির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। চাল রপ্তানির পরিমাণ, সময়সীমাসহ দামও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
  
যদিও রপ্তানিকারকদের দাবি  ছিল বছরে ৫০ হাজার টন রপ্তানি ও প্রতি কেজির রপ্তানির দর ১ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার নির্ধারণের। কিন্তু  সরকার অনুমোদন দিয়েছে ৬ মাসের জন্য ২৫ হাজার টন ও দর দিয়েছে ১ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলার। 

এদিকে দেশের রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সুগন্ধি চাল ভারতে পাচার হয়ে থাকে। কারণ উৎপাদন এলাকায় চালের দাম অনেক কম। সেসব চাল ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির নকল প্যাকেটে এতদিন রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় কিছু অসাধু রপ্তানিকারক এ দেশ থেকে চাল নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করে বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশের সুনামকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। সেখান থেকে বের হতে দেশ থেকে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ আবার উন্মুক্ত করেছে সরকার।

তবে এবার বেঁধে দেওয়া হয়েছে চাল রপ্তানির পরিমাণ ও ন্যূনতম দাম। এখন বছরে দেশ থেকে রপ্তানি করা যাবে ২৫ হাজার টন চাল। প্রতিকেজির নূন্যতম দাম হবে ১ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলার। আগামী ছয় মাসের মধ্যে রপ্তানির কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য রপ্তানিকারকদের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা গত মঙ্গলবার বৈঠক করে রপ্তানি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় এখন ঠিক করে দেবে কারা কারা রপ্তানি করবে, কে কী পরিমাণে রপ্তানি করবে।’

জানা গেছে, এ কমিটি দেশে কী পরিমাণ সুগন্ধি চাল উৎপাদন হচ্ছে, এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কত সেটি নির্ধারণ করেছে। এরপর কী পরিমাণ চাল কত দামে বিদেশে রপ্তানি করা যায় তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেয়। বিগত বছর দেশে ১৫ লাখ ৮০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে বলে ওই সভায় জানায় কৃষি বিভাগ।

এদিকে রপ্তানি প্রসঙ্গে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক  বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর সরকার সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে। বাপা থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, বছরে ৫০ হাজার টন রপ্তানি ও প্রতি কেজির রপ্তানির দর ১ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার নির্ধারণের জন্য। কিন্তু অনুমোদন দিয়েছে ৬ মাসের জন্য ২৫ হাজার টন ও দর দিয়েছে ১ দশমিক ৬০ মার্কিন ডলার।

তিনি বলেন, এখন চাল রপ্তানিকারকদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুবিভাগে আবেদন করে কোম্পানি অনুযায়ী অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদনের সঙ্গে উল্লিখিত কিছু শর্তাবলিও পরিপালন করতে হবে।

বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সুগন্ধি চাল রপ্তানি শুরু হয়। ২০২২ সালে এসে প্রথমবার চাল রপ্তানি বন্ধ করা হয়। এরপর মাঝে কিছু অনুমতি দিলেও ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করেছিল সরকার। তবে রপ্তানি শুরুর পর থেকে দ্রুত বেড়ে সুগন্ধি চাল বাংলাদেশি রপ্তানি ঝুড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য হয়ে উঠেছিল।

এরপর সুগন্ধি চালের কারণে অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এরপর থেকে রপ্তানি আয় বাড়াতে দেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার। এদিকে বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি বন্ধ থাকার সময় এ বাজার দখল করেছে ভারত। 

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ কমিটির সভায় জানান, দেশের রপ্তানি বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সুগন্ধি চাল ভারতে পাচার হচ্ছে। কারণ উৎপাদন এলাকায় চালের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। সেসব চাল ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির নকল প্যাকেটে এতদিন রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ ভারতীয় কিছু অসাধু রপ্তানিকারক এ দেশ থেকে চাল নিয়ে তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করে বিদেশে রপ্তানি করছে।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের মধ্যে সুগন্ধি চালের উল্লেখযোগ্য চাহিদা রয়েছে।

ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ বলেন, বাংলাদেশের সুগন্ধি চাল এখন বিদেশের অনেক দেশে ব্র্যান্ড প্রোডাক্ট। এটি কখনো চালু, কখন বন্ধ করে সরকার বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করেছে। রপ্তানি বন্ধ থাকলে সব সময় দেশে উদ্বৃত্ত সুগন্ধি চাল থেকে যায়, চাষীরা দাম পায় না। গত কয়েক বছর সেটা হয়েছে। দেশে কোনো উপলক্ষ-অনুষ্ঠান ছাড়া এ চালের চাহিদা নেই।

তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানির ঝুড়িতে সুগন্ধি চাল একটি জনপ্রিয় আইটেম। চাল না দিতে পারলে অনেক সময় অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। যে কারণে মাঝখানে গত কয়েক বছর কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে।
দেশ থেকে প্রথম বছর ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। পরের বছরগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার ৮৭৯ টনে উন্নীত হয়। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৬ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৫ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫১ লাখ মার্কিন ডলারের সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছিল।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বছরে গড়ে সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয় ১৮-২০ লাখ টন। আর আগে বছরে গড়ে রপ্তানি হয়েছে ১০ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদনের তুলনায় চালের রপ্তানির হিস্যা অনেক কম। যে কারণে চাল রপ্তানিতে খাদ্য নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি নেই বলে বারবার দাবি করে আসছেন রপ্তানিকারকরা।

এ পর্যন্ত বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়েছে।

দেশে রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চালের একটি তালিকা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। চালগুলো হচ্ছে কালিজিরা, কালিজিরা টিপিএল-৬২, চিনিগুঁড়া, চিনি আতপ, চিনি কানাই, বাদশাভোগ, কাটারিভোগ, মদনভোগ, রাঁধুনিপাগল, বাঁশফুল, জটাবাঁশফুল, বিন্নাফুল, তুলসীমালা, তুলসী আতপ, তুলসী মণি, মধুমালা, খোরমা, সাককুর খোরমা, নুনিয়া, পশুশাইল, দুলাভোগ ইত্যাদি।

MN
আরও পড়ুন