ভারতের অরুণাচল প্রদেশের একটি দুর্গম পাহাড়ি খাদ থেকে নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর মিলল শ্রমিকবাহী একটি ট্রাকের ধ্বংসাবশেষ। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আঠারো জন শ্রমিকের লাশ। শ্রমিকেরা সবাই অসমের তিনসুকিয়া জেলার বিভিন্ন চা বাগান এলাকার মানুষ।
নির্মাণস্থলে কাজের জন্য রাতে পাহাড়ি পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন তারা। কিন্তু সরু খাড়া রাস্তার এক বাঁকে ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় এক হাজার ফুট গভীর খাদে গিয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার পর দুই দিন পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত কোনো তথ্য পায়নি। পাহাড়ি অন্ধকার এলাকা এবং ঘন জঙ্গল থাকার কারণে ট্রাকটির কোনও সন্ধান মিলছিল না।
ঘটনার মোড় ঘোরে তখন, যখন একমাত্র জীবিত শ্রমিক কোনোরকমে জিআরইএফ ক্যাম্পে পৌঁছে দুর্ঘটনার কথা জানান। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১১ ডিসেম্বর সকাল থেকে ব্যাপক অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। সেনাবাহিনী স্থানীয় পুলিশ এনডিআরএফ এসডিআরএফ এবং প্রশাসনের কয়েকটি বিশেষ দল দ্রুত ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন। পাহাড়ি খাদ এতটাই খাড়া যে উদ্ধারকারীদের দড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার অনুসন্ধানের পর ঘন জঙ্গলের গভীরে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ট্রাকটির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল শ্রমিকদের নিথর দেহ। বেশিরভাগ দেহে গভীর আঘাতের চিহ্ন ছিল।
তিনসুকিয়ার প্রশাসন জানিয়েছে, নিহতদের পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। দেহগুলো অত্যন্ত দুর্গম স্থানে থাকায় উদ্ধার করতে সময় লাগছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনার রাতে পাহাড়ি রাস্তার পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল। রাস্তার বড় অংশে আলোর ব্যবস্থা নেই। কোথাও রেলিং নেই। প্রতিদিন শত শত শ্রমিককে এসব ঝুঁকিপূর্ণ রুটে যাতায়াত করতে হয়। শ্রমিক পরিবহনের গাড়িগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত হয় কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী। তাদের মতে বছরের পর বছর পাহাড়ি সড়কের অবাঞ্ছিত অবস্থা মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ট্রাক চালকদের অনেক সময় দীর্ঘ সময় পরপর কাজ করতে হয়। ফলে পাহাড়ি বাঁক ও নরম মাটির রাস্তা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
নিহতদের বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। দুর্ঘটনার সংবাদ পৌঁছানোর পর তিনসুকিয়ার চা বাগান এলাকায় কান্নার রোল উঠেছে। পরিবারগুলো দেহ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দেহ শনাক্তের পর আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।
উদ্ধারকারী দল জানায় খাদটি এত গভীর এবং ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত যে আকাশপথ থেকেও ট্রাকটি দেখা যায়নি। একমাত্র জীবিত ব্যক্তির বর্ণনা না থাকলে দুর্ঘটনার মূল স্থান শনাক্ত করা কঠিন ছিল। সেনাবাহিনীর দল পাহাড়ি পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দড়ি বেয়ে নিচে নেমেছে। চার ঘণ্টার টানা অভিযানে তারা জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হয়ে ট্রাকের ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পায়।
এই দুর্ঘটনা আবারও সামনে তুলে ধরল পাহাড়ি শ্রমিক পরিবহনের নিরাপত্তাহীনতা। এলাকার শ্রমিকরা বলছেন দুর্ঘটনার পর প্রশাসন এসে পড়ে কিন্তু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা খুব কম দেখা যায়। পাহাড়ি অঞ্চলের সড়কগুলো নিয়মিত সংস্কার করা হয় না। শ্রমিকরা প্রায় প্রতিদিন জীবনবাজি রেখে যাতায়াত করেন। তাদের দাবি নিয়মিত নজরদারি ও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে এমন ঘটনা ভবিষ্যতেও রোধ করা যাবে না।
এখন পর্যন্ত আঠারো জনের দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কোনও শ্রমিক নিখোঁজ আছে কি না তা নিশ্চিত করার কাজ চলছে। জঙ্গলঘেরা খাদটির অন্ধকার এবং দুর্গম অবস্থা উদ্ধার অভিযানকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তিনসুকিয়ার প্রশাসন তেজুতে বিশেষ সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পরিবারগুলো দূরত্বের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও খবরের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। পাহাড়ি এই দুর্ঘটনা শুধু আঠারোটি প্রাণই কেড়ে নিল ন, বরং সামনে এনে দিল শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের নিরাপত্তাহীন বাস্তবতা।
মেট্রোরেল নির্ধারিত সময় অনুযায়ী চলবে