পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের মধ্য দিয়ে বহমান খালগুলোতে অপ্রশস্ত বক্স কালভার্ট যেন গলার কাঁটা।
অপরিকল্পিতভাবে অপ্রশস্ত বক্স কালভার্ট নির্মাণের ফলে খালগুলোর পানিপ্রবাহের ধীরগতি, পলিমাটি জমে এবং খাল পাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দাদের বাসা-বাড়ির বর্জ্য ফেলায় দুই পাড় বিস্তৃত হয়ে একটি ‘বটলনেক’ বা সরু জায়গা তৈরি হয়েছে। এই সরু জায়গায় কাদামাটি, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ বিভিন্ন আবর্জনা জমে খালের মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশন।

ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্র তথা জলজ প্রাণির, বিশেষ করে মাছের চলাচলে বাধা সৃষ্টি এবং কৃষি ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট দেখা দিচ্ছে। তাই বক্স-কালভার্টের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণ করা ও খালের প্রবাহ ঠিক রাখতে বক্স কালভার্টের পরিবর্তে খালের প্রশস্ত সমান সেতু বা ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজন।
পৌর শহরের অভ্যন্তরে বাদুরতলীর খালটি প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর প্রস্থ অবস্থান ভেদে ২০০ থেকে ৪০০ ফুট। অথচ স্লুইস সংযুক্ত এই খালটির একাধিক স্থানে মাটির বাঁধ দিয়ে ১৫-২৫/৩০ ফুট প্রস্থ বক্স কালভার্ট নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ফলে ক্রমশ পলির আস্তরণে ভরাট হয়ে গেছে।
এছাড়া দুইপাড়ে খাল দখল করে অসংখ্য স্থাপনা করা হয়েছে। বাড়িঘর থেকে পুকুর পর্যন্ত করা হয়েছে। এভাবে খালের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে দেওয়ায় খালটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এই খালের পানি টিয়াখালী ইউনিয়নের একাংশসহ পৌরসভার শত শত মানুষ কৃষিকাজসহ নিত্যদিনের কাজে ব্যবহার করছেন।
একই অবস্থা চিংগুরিয়া খালটির অবস্থা। প্রায় ৭০-৮০ ফুট প্রস্থ খালটিতে মূল সড়ক করতে মাত্র ৫-৭ ফুট প্রস্থ একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বাদ যায়নি পৌর শহরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাল। এটি ফায়ার সার্ভিস ও নাচনাপাড়া মদিনাবাগ হয়ে বাসন্তী মন্ডল স্কুল হয়ে আড়-পাঙ্গাসিয়া নদীতে মিলেছে। ওই খালটির অবস্থা আরও খারাপ।

অপ্রশস্ত ২০/২৫ ফুট প্রস্থের ঘনঘন বক্স কালভার্ট এবং খালের মধ্যে স্থানীয়দের বসতি নির্মাণে সংকুচিত একসময়ের ৭০/৮০ ফুট প্রশস্ত খালটি মৃতপ্রায়। চাকামইয়া নিশানবাড়িয়া থেকে দিত্তার দিকে বহমান অন্তত ১০০ ফুট প্রস্থ খালে মাত্র ২০ ফুট প্রস্থ একটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এভাবে উপজেলার শত শত খালের পানিপ্রবাহ আটকে অপরিকল্পিতভাবে যোগাযোগের সড়ক নির্মাণের নামে অপ্রশস্ত বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
আবার কোথাও কোথাও বাঁধ দিয়ে পানি চলাচলের পথ সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব স্লুইস সংযুক্ত ড্রেনেজ খালগুলোয় অপ্রশস্ত বক্স-কালভার্ট নির্মাণ করায় শত শত খালের পানির প্রবাহ আটকে ভরাট হয়ে গেছে। খালগুলো মরা খালে পরিণত হয়েছে। এসব খালকে আবার আশির দশকে স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।
এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এভাবে অপরিকল্পিত উন্নয়নের পাশাপাশি ভূমি অফিসের এক শ্রেণির কর্মচারী ও তাদের দালালদের যোগসাজশে খালগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে গত ১০ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার ধকলে পড়ছেন কৃষকসহ সাধারণ মানুষ। আর শুকনো মৌসুমে থাকছে না রবি শস্যসহ সবজি চাষের স্বাদু পানি। কৃষি ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

কৃষক সুলতান গাজী জানান, খালের পানি চলাচলের পথ বন্ধ করা সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। ১০টি বক্স কালভার্ট না করে খালের প্রস্থ সমান একটি গার্ডার ব্রিজ করলে এই স্থায়ী সমস্যা হতো না। খাল না থাকলে পানি থাকবে না। আর পানি না থাকলে কৃষি উৎপাদন থাকবে না। আর পরিবেশের বিপর্যয় তো হবেই।
পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা–ধরা’র স্থানীয় সমন্বয়কারী ও নদী রক্ষা আন্দোলনের কর্মী মেজবাহউদ্দিন মাননু বলেন, “খালের স্বাভাবিক পানির প্রবাহ কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। সরকারিভাবে খালের উপরে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য পরিকল্পনায় স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কোন ধরনের পরামর্শ করা হয় না। তাদের মতামত নেওয়া হয় না। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ধ্যান-ধারণায় খালে বাঁধ ও অপ্রশস্ত বক্স কালভার্ট নির্মাণ করে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। এক পশলা বৃষ্টি হলেই গ্রাম শহর সর্বত্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
তিনি আরও বলেন, মূল কথা হচ্ছে খাল যতটুকু প্রস্থ ওই মেজারমেন্টের বক্স কালভার্ট করতে হবে প্রয়োজনে গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি পানির প্রবাহ আটকে ছোট ছোট নির্মাণ করা কালভার্ট ভেঙে পানির প্রবাহ সচল করার পরামর্শ তার।

আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ইয়াকুব খান বলেন, পানি নিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃতির সৃষ্টি বড় নেয়ামত খাল, এ খালগুলোতে অপ্রশস্ত বক্স-কালভার্ট তৈরি হওয়ার কারণে পানি প্রবাহে বিঘ্ন ও নাব্যতা রক্ষায় মূল প্রতিবন্ধকতা। ওই সকল খালের সি.এস ম্যাপ দেখে সীমানা নির্ধারণ করে দখলমুক্ত, প্রশস্ত ব্রিজ নির্মাণ ও সংস্কার করে ড্রেনেজ সিস্টেমকে উন্নত ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা সময়ের দাবি।”
কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসিন সাদীক দৈনিক খবর সংযোগকে জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে আটকে পড়া ও ভরাট খালগুলো পুনরুদ্ধার এবং পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন সব অবৈধ স্থাপনা আপসারণে গত ৬ মাসে অর্ধশতাধিক অবৈধ বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে। পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে এই অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় এখন খাল খনন কিংবা কোন প্রকল্প নেওয়া হলে কৃষকের পরামর্শ নিয়েই করা হবে।
নাজিরপুরে ঝুঁকিপূর্ণ কালভার্ট, চলাচলে দুর্ভোগ