আপনার প্রথম বেতনের চেক বা ব্যাংক স্টেটমেন্ট যখন হাতে আসে, অনুভূতিটা কেমন হয়? সম্ভবত আনন্দের সঙ্গে এক রাশ দায়িত্ববোধের মিশ্রণ! দীর্ঘদিনের পড়াশোনার পর কর্মজীবনে প্রবেশ আর প্রথম উপার্জনের এই টাকাটা যেন আপনার স্বাধীনতার প্রতীক। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, এই টাকা দিয়ে কী করব? নতুন মোবাইল কিনব, নাকি পরিবারকে কিছু উপহার দেব? নাকি সবটাই জমিয়ে রাখব?
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম বেতনের সঠিক ব্যবস্থাপনা আপনার সারাজীবনের অর্থনৈতিক অভ্যাসের ভিত গড়ে দিতে পারে। এই মূল্যবান সম্পদটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য নিচে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আলোচনা করা হলো, যা আপনাকে 'খরচকারী' থেকে 'সম্পদশালী' হওয়ার পথে এগিয়ে দেবে।
১. শূন্য-ভিত্তিক বাজেট তৈরি করুন: আগে বাজেট, পরে খরচ
প্রথমেই মনে রাখবেন, বেতন পাওয়ার আগে আপনাকে জানতে হবে, এই টাকা ঠিক কোথায় কোথায় যাবে। 'যা থাকবে, তা বাঁচাব' এই মানসিকতা বাদ দিয়ে 'যা বাঁচাব, তা আগে সরিয়ে রাখব' এই মানসিকতা গড়ে তুলুন।
পদ্ধতি: আপনার মাসিক বেতনের একটি তালিকা তৈরি করুন, যেখানে প্রতিটি টাকা একটি নির্দিষ্ট খাতে বরাদ্দ করা থাকবে।
প্রয়োজনীয় খরচ (৫০শতাংশ): বাসা ভাড়া, খাবার, যাতায়াত, বাবা-মায়ের জন্য নির্দিষ্ট খরচ, মাসিক বিল (বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট)।
সঞ্চয় ও বিনিয়োগ (২০শতাংশ): এটি আপনার ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। (নিচের ২ ও ৩ নম্বর ধাপে দেখুন)।
ব্যক্তিগত খরচ (৩০শতাংশ): বিনোদন, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা, শপিং, পছন্দের গ্যাজেট কেনা।
বাংলাদেশি টিপস: শুরুতেই একটি জরুরি তহবিল (Emergency Fund) তৈরি করুন। কমপক্ষে ৩ থেকে ৬ মাসের জীবনধারণের খরচ একটি সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমিয়ে রাখুন। চাকরি চলে গেলে বা হঠাৎ অসুস্থ হলে এই টাকা আপনাকে বাঁচিয়ে দেবে।
২. 'EMI-ফাঁদ' থেকে নিজেকে বাঁচান: ক্রেডিট কার্ড নয়, ডেবিট কার্ডে শুরু করুন
প্রথম বেতনের হাত ধরেই আসে ক্রেডিট কার্ডের লোভনীয় অফার অথবা কিস্তিতে (EMI) নতুন গ্যাজেট কেনার সুযোগ। নতুন চাকরিজীবীদের জন্য এই ফাঁদটি সবচেয়ে বিপজ্জনক।
ক্রেডিট কার্ডের ঝুঁকি: ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা ভালো, কিন্তু যদি বিল সময়মতো পরিশোধ করতে না পারেন, তবে উচ্চ সুদের হারে আপনার মাসিক বাজেট ভেঙে যেতে পারে। বাংলাদেশের উচ্চ সুদের হার আপনার সঞ্চয়ের সব পথ বন্ধ করে দেবে।
পদ্ধতি: প্রথম ৬ মাস ক্রেডিট কার্ড বা কিস্তিতে কিছু কিনবেন না। যদি একান্তই কিনতে চান, তবে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে সেই জিনিসটি কিনুন, যা আপনার সঞ্চয় ২০শতাংশ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকায় কুলিয়ে যায়।
গুরুত্বপূর্ণ কথা: মনে রাখবেন, আপনার কাছে যখন টাকা নেই, তখন ক্রেডিট কার্ডের টাকা ধার নেওয়া আপনার বেতনকে পরের মাসের আগেই 'ভবিষ্যতের ঋণ' হিসেবে গ্রাস করে নেবে।
৩. বিনিয়োগের বীজ আজই রোপণ করুন: ‘ডিপিএস’ দিয়ে শুরু হোক যাত্রা
আপনার প্রথম বেতনের যে ২০শতাংশ অংশ আপনি সঞ্চয়ের জন্য আলাদা করলেন, তা যেন আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্টে অলসভাবে পড়ে না থাকে! মূল্যস্ফীতির এই যুগে টাকা ফেলে রাখা মানেই লস।
ডিপিএস (DPS) শুরু: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুনদের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং ঝুঁকিবিহীন বিনিয়োগ হলো ডিপিএস (ডিপোজিট পেনশন স্কিম)। প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা (যেমন: ১০০০ বা ২০০০ টাকা) আপনার ব্যাংক থেকে সরাসরি ডিপিএস অ্যাকাউন্টে কেটে নেওয়া হবে।
কেন জরুরি: আপনি যখন ছোট অঙ্কের টাকা লম্বা সময় ধরে জমাবেন, তখন চক্রবৃদ্ধি সুদের (Compounding Interest) জাদুতে আপনার সঞ্চয় দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকবে। এই ছোট বিনিয়োগই ১০ বছর পর আপনার বড় পুঁজি হবে।
পরবর্তী ধাপ: ডিপিএস-এ অভ্যস্ত হয়ে গেলে এরপর সেভিংস সার্টিফিকেট (সঞ্চয়পত্র) অথবা শেয়ার বাজারে অল্প অল্প করে বিনিয়োগের কথা ভাবুন।
৪. পরিবারকে অগ্রাধিকার দিন, কিন্তু আর্থিক সীমা টানুন
প্রথম বেতন হাতে পেলে স্বভাবতই ইচ্ছা হবে মা-বাবা বা প্রিয়জনদের জন্য কিছু করার। এটি একটি দারুণ মানবিক দিক, তবে এক্ষেত্রেও আপনাকে কৌশলী হতে হবে।
অতিরিক্ত চাপ নেবেন না: বাংলাদেশে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ অনেক বেশি, কিন্তু আপনার প্রথম বছরটি হলো আপনার নিজের অর্থনৈতিক ভিত শক্ত করার সময়। শুরুতেই পুরো বেতনের একটি বড় অংশ পরিবারকে দিয়ে দিলে আপনার নিজের সঞ্চয়ের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে।
উপহার বনাম মাসিক দায়িত্ব: প্রথম বেতনে একটি স্মরণীয় উপহার দিন। কিন্তু মাসিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে বসে আলোচনা করুন। নিজের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রতি মাসে পরিবারের জন্য বরাদ্দ করুন।
ফলাফল: এতে পরিবার খুশি হবে, এবং আপনার নিজেরও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের পথ খোলা থাকবে। আপনার আর্থিক স্বাবলম্বিতা দীর্ঘ মেয়াদে আপনার পরিবারকেই বেশি নিরাপত্তা দেবে।
৫. নিজের দক্ষতায় বিনিয়োগ করুন: আপনার 'ব্রেইন' হলো সেরা সম্পদ
আপনার এই চাকরি হয়তো আপনার শেষ চাকরি নয়। কর্মজীবনে এগিয়ে যেতে হলে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে হবে। তাই বেতনের একটি ক্ষুদ্র অংশ আপনার নিজস্ব উন্নয়নে খরচ করুন।
বিনিয়োগের খাত: পেশাগত কোর্স বা প্রশিক্ষণ (যেমন: ডিজিটাল মার্কেটিং, অ্যাডভান্সড এক্সেল, ডেটা অ্যানালাইসিস)। গুরুত্বপূর্ণ বই ও পত্রিকা কেনা। নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট বা সেমিনারে অংশগ্রহণ।
মনে রাখবেন, আপনার দক্ষতা হলো আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই বিনিয়োগের প্রতিদান আপনি আগামী বছরগুলিতে বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফেরত পাবেন। প্রথম বেতন মানে শুধুই টাকা নয়, এটি আপনার অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার সূচনালগ্ন। এই ৫টি সহজ ধাপ মেনে চললে আপনি বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলেও নিজেকে একজন সফল ও স্বাবলম্বী পেশাজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এখন আর দেরি না করে, আপনার প্রথম বেতনের জন্য একটি 'স্মার্ট বাজেট' তৈরি করে ফেলুন!
ছাত্রজীবনে ইন্টার্নশিপের গুরুত্ব
যেভাবে সামলাবেন অফিসের টক্সিক কলিগকে
যেভাবে বাড়বে আপনার আত্মবিশ্বাস