হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বৈঠকের প্রায় ১৬ দিন পর এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের (এপিবিএন) অধিনায়কের প্রত্যাহার চাওয়া নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এপিবিএনের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সিহাব কায়সার খান শিষ্টাচার-বহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন- এমন অভিযোগে বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমোডর আসিফ ইকবাল পুলিশ প্রধানের (আইজিপি) কাছে সরাসরি চিঠি দিয়ে তার (কায়সার খান) প্রত্যাহার দাবি করেছেন।
বেবিচকের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন চিঠি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে- তিনি আইজিপির কাছে সরাসরি এ ধরনের চিঠি পাঠাতে পারেন কিনা? এছাড়া ওই বৈঠকের ১৬ দিন পর কেন এই চিঠি? বৈঠকে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে এপিবিএনের প্রধান কী বক্তব্য রেখেছেন, যা শিষ্ঠাচার বহির্ভূত মনে হলো, এমন অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আহমেদ বিমানবন্দর পরিদর্শনে যান। তিনি তখন বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব, বেবিচক চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এপিবিএনের অধিনায়কসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের এক পর্যায়ে উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এপিবিএনের প্রধান সিহাব কায়সার খানের কাছে বাহিনীর বর্তমান কার্যক্রমসহ কিছু বিষয় জানতে চান। এপিবিএনের অধিনায়ক উপদেষ্টাকে সেসব অবহিত করেন। পাশাপাশি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে বিমানবন্দরে অবস্থান নিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তিনি উপদেষ্টাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশে যখন পুলিশের কর্মবিরতির ব্যাপার ছিল, তখন ওই জায়গাটায় ওই ভ্যাকিউমের সময় কিউআরএফ ফ্রম এয়ার ফোর্স ডিপ্লয়মেন্ট হয়। আপনারা (বাংলাদেশ বিমানবাহিনী) যদি ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারে’ আসেন… তাহলে বর্তমানে সেনাবাহিনী যেভাবে কাজ করছে- জেলায় ও মেট্রোতে- তারা সবাই কিন্তু এইড করছে, কাকে? সিভিল পাওয়ারকে। মানে পুলিশকে এইড করছে। আপনারা (বিমান বাহিনী) তো আমাকে (এপিবিএন) এইড করছেন না, আপনারা তো আমাকে রিপ্লেস করে ফেললেন, আমি তো আমার জায়গাতে নাই।’
তখন উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা পরবর্তীকালে বসে বিষয়টি সমাধান করবো।’
ওই বৈঠকের ১৬ দিন পর বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) মো. আসিফ ইকবাল পুলিশ প্রধানের (আইজি) কাছে চিঠি পাঠিয়ে সিহাব কায়সার খানের ওই বক্তব্যকে শিষ্ঠাচার-বহির্ভূত বলে দাবি করেন। একইসঙ্গে ওই চিঠিতে এপিবিএনের অধিনায়ক সিহাব কায়সারকে প্রত্যাহার এবং অন্য কাউকে অধিনায়ক হিসেবে এপিবিএনে পাঠানোর কথা বলা হয়।
চিঠির বিষয়ে বেবিচকের মুখপাত্র কাওছার মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’
বেবিচক কর্মকর্তা আসিফ ইকবালের পাঠানো চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বেবিচক কর্তকর্তার চিঠি নিয়েও আলোচনা হয়। বেবিচকের কর্মকর্তা এ ধরনের চিঠি দিতে পারেন কিনা, তা নিয়ে বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হয়।
সভায় পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, একটি বাহিনীর প্রধানকে তিনি এভাবে লিখতে পারেন না। তার কর্মপরিধিতে এমন এখতিয়ারও নেই। আর বিষয়টি ১৬ দিন আগের। যেখানে উপদেষ্টা নিজে ও মন্ত্রণালয়ের সচিব উপস্থিত ছিলেন। শিষ্টাচার লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো সমীচীন ছিল। কিন্তু তারা (মন্ত্রী ও সচিব) এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। বৈঠকের ১৬ দিন পর বেবিচকের একজন কর্মকর্তার এ ধরনের চিঠি পাঠানোর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, এপিবিএনের অধিনায়ক সিহাব কায়সার খান মিথ্যা বা বানোয়াট কিছুই বলেননি— যা সত্য, তিনি উপদেষ্টার কাছে তা তুলে ধরেছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের বৈঠকে কর্মকর্তারা বলেন, এখানে শিষ্টাচার লঙ্ঘনের কোনো কিছুই ছিল না। ফলে বেবিচক কর্মকর্তা শিষ্টাচার লঙ্ঘনের অভিযোগে তুলে আইজিপিকে যে চিঠি দিয়েছেন, সেটি বরং আমাদের বিস্মিত করেছে।
জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সাবেক সরকারের পতন হলে পরিস্থিতি বিবেচনায় আর্মড পুলিশের সদস্যরা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। এ সময় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’এর আওতায় বিমান বাহিনীর সদস্যরা বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন। পরে বাংলাদেশ পুলিশের অন্যান্য ইউনিট কাজে ফেরার আগেই এপিবিএন বিমানবন্দরে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে যোগ দেয়। কিন্তু তারা আগের মতো বিমানবন্দরের এয়ারসাইটে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। গত ২৯ অক্টোবর এয়ারসাইটে এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটিকে নিজেদের অফিস বানান বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
এরপর ওই অফিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি ও মালামাল খোয়া গেছে- অভিযোগ এনে বিমানবন্দর থানায় একটি জিডি করে এপিবিএন। পরে বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদরদপ্তরে আইজিপির উপস্থিতিতে বেবিচক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে জিডি প্রত্যাহারের পর এপিবিএনকে আগের মতো এয়ারসাইটে ডিউটি করার প্রতিশ্রুতি দেন বেবিচক চেয়ারম্যান। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি এপিবিএন জিডি প্রত্যাহার করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি এপিবিএন তাদের সদস্যদের এয়ার সাইটে মোতায়েন করতে চাইলে বেবিচক তাতে বাধা দেয়। এখনও পর্যন্ত আইজিপিকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বেবিচক। বর্তমানে এপিবিএন বিমানবন্দরের বাইরে (ল্যান্ড সাইট) দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
