ভোটের মাঠে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপির কৌশল

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৫৯ এএম

তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ঠিক দুই মাস পর অনুষ্ঠিত হবে এই নির্বাচন। সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর দলগুলোকে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে দেখা গেলেও, এবার সে কাজটি অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে নির্বাচন ঘিরে আলোচিত তিন দল- বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

ইতোমধ্যে এই তিন দল তাদের অধিকাংশ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি, জোট গঠন ও আসন সমঝোতা নিয়েও দলগুলোর কৌশলগত নানা খবর গণমাধ্যমে উঠে আসছে। জামায়াতে ইসলামী প্রথমবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রার্থী ঘোষণা করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রকাশ্য বিক্ষোভ দলটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের দুই সম্মুখসারির ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তারা এনসিপিতে যোগ দেবেন নাকি অন্য কোথাও তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

তফসিল পরবর্তী সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও প্রস্তুতি নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

বিএনপি: দেশের বাইরে শীর্ষ নেতৃত্ব, মাঠে বিদ্রোহী প্রার্থী

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। ১৬ মাস পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় নির্বাচনি কার্যক্রম কতটা গোছানো হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বিএনপি দুই দফায় ২৭২টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে মনোনয়নবঞ্চিতদের অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করায় দলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়ন ঘোষণার একদিন পরই ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে প্রার্থী বদল করতে বাধ্য হয় দলটি।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। তার অনুপস্থিতি ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করছেন পর্যবেক্ষকরা। মনোনয়নকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দ্বন্দ্ব প্রচারণায় ধীরগতি আনছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

জোট বা আসন সমঝোতার জন্য বিএনপি ২৮টি আসন ফাঁকা রেখেছে। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপির) এবং গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতাদের জন্য আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দারের জন্যও আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম নিজ দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন এবং মনোনয়ন পেয়েছেন।

জামায়াতে ইসলামী: হিন্দু প্রার্থী ও আট দলের সঙ্গে সমঝোতা

নির্বাচনের আগে সংস্কার ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল জামায়াতে ইসলামী। প্রার্থী ঘোষণায় দলটি সবার চেয়ে এগিয়ে। বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন জেলায় সমাবেশ করে প্রার্থী ঘোষণা করে আসছে তারা। তফসিল ঘোষণার দিন পর্যন্ত ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে দলটি, তবে চূড়ান্ত তালিকা এখনও প্রকাশ করেনি।

জামায়াত ধর্মভিত্তিক আটটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতার পরিকল্পনা করছে। দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ জানান, আট দলের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণ করা হবে। ফলে ঘোষিত তালিকা থেকে অনেক প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন।

প্রথমবারের মতো খুলনা ও কিশোরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুজনকে মনোনয়ন দিয়ে জামায়াত ভোটের মাঠে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কোনো নারী প্রার্থী না থাকায় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকার কারণে দলটি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

এনসিপি: নতুন জোট ও দুই ছাত্রনেতার গন্তব্য

জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তফসিল ঘোষণার আগেই ১২৫টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও এবি পার্টির সঙ্গে মিলে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ গঠন করেছে দলটি। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে।

এদিকে, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এনসিপিতে যোগ দেবেন বলে শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত বনিবনা না হওয়ায় তিনি ঢাকা-১০ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আরেক ছাত্রনেতা মাহফুজ আলমও পদত্যাগ করেছেন এবং লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে নির্বাচনের গুঞ্জন রয়েছে। এনসিপি নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য থাকলেও তিনি শেষ পর্যন্ত কোন দলে যোগ দেবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

জাতীয় পার্টি: ভাঙন ও নতুন জোট

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় এবারের নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। জাতীয় পার্টিকেও ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ আখ্যা দিয়ে নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবি উঠেছে। দলটির মধ্যে ভাঙন ধরেছে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে একটি অংশ এবং জি এম কাদেরের নেতৃত্বে অপর অংশ পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার ও ‘মূল দল’ দাবির লড়াইয়ে লিপ্ত। আনিসুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন অংশ ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ (এনডিএফ) নামে ১৮ দলীয় জোট গঠন করেছে। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে জাতীয় পার্টির কোনো অংশই ডাক পায়নি।

DR/SN